নিজে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র, টেনিদা’কে টানা সাত বছর ফেল করালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতার তরুণ সাহিত্যিকরা তখন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন। সেইসময় ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এলেন দিনাজপুরের ছেলে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তারকনাথ, বাল্যবন্ধু নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে লিখে ফেলেন তিনটি কিশোরপাঠ্য কাহিনি, 'বিভীষিকার মুখে', 'নটরাজের চোখ' এবং 'একখানি কালো হাত'। গোল্ড মেডেল পাওয়া নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তোলা থাকল বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায়, লেখকের নাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।

তারপর বাংলা কিশোরসাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত তিনটি গল্প; 'অথ নিমন্ত্রণ ভোজন', ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’ এবং ‘সভাপতি’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যের আকাশে নারায়ণী ধ্বজা উড়তে থাকে। ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’ গল্পেই জন্ম বাংলা কিশোর সাহিত্যের কিংবদন্তি আইকন টেনিদার।

সেবছরই পত্নী আশা দেবীর সঙ্গে উঠে এসেছেন পটলডাঙা স্ট্রিটের ২০ নম্বর বাড়ির দোতলায়। বাড়িওয়ালার পুত্র প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লেখকের প্রায় সমবয়সী। দুজন আড্ডাবাজ মানুষের সদ্ভাব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। প্রভাতকুমারের ডাকনাম ও চেহারা নিয়ে নিজের কল্পনারসে গড়ে তুললেন 'টেনিদা'। সাতবছর ধরে ক্লাস টেনে স্থায়ী হয়ে আছেন টেনিদা। তার সঙ্গে গল্পকথক প্যালারাম। পালজ্বরে ভোগে আর পটল দিয়ে শিঙ্গি মাছের ঝোল খায়। ঢাকার কাঠ বাঙাল হাবুল। তার অবস্থাও তথৈবচ। আর একমাত্র চৌখস ছেলে ক্যাবলা। এই চারজনকে নিয়ে চারমূর্তি। পটলডাঙার চারমূর্তির গল্প বাংলার কচিকাঁচাদের মন জয় করে নিল এক লহমায়। আর বাংলা কিশোরসহিত্যের সিংহাসনে বসলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।

শুধু কি কিশোরসাহিত্য? অসংখ্য সামাজিক উপন্যাস লিখেছেন তিনি। অনেকে ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসাঁর সঙ্গে তুলনা করেন তাঁকে। লেখকের কথায়, তিনি বিশ্লেষণপন্থী নন, আস্বাদনপন্থী। ফিকশন লেখার পাশাপাশিলিখেছেন বহু নন-ফিকশন ফিচার। 'সুনন্দর জার্নাল' নামে সেই লেখাগুলি কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অব্যক্ত সব ইতিহাসের সাক্ষী। আবার সাহিত্য সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষুরধার বিশ্লেষণের কথাও অস্বীকার করা যায় কি?

তবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নামের আড়ালে কখনো চাপা পড়েননি তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে টিএনজি। কতো না কৃতী ছাত্র তৈরি করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। শঙ্খ ঘোষ, অলোক রায়, সুধীর চক্রবর্তীর মত গবেষকের পাশাপাশি তাঁর ছাত্র ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, আনন্দ বাগচী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে কখনো সমাজ বিচ্ছিন্ন চোখে দেখতেন না তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার কারণে একবছর আইএ পরীক্ষা দিতে পারেননি তিনি। তারপরেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নাম্বার পেয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি চাইতেন ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকুক। তাই উত্তাল সময়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে আশীর্বাদ না করে থাকতে পারেননি।

বিচিত্র প্রতিভার এই মানুষটি দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হতে পারেননি। ১৯৭০ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেমন হারায় এক অদ্বিতীয় শিক্ষককে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা হারালেন 'টেনিদা'কে। লেখকপত্নী আশা দেবী পরে সেই কাহিনি খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য টেনিদাকে হাজির করেছেন সিনেমার পর্দায়। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে পা রেখে কল্পনায় আকাশ ছুঁতে আর কজন পারেন?

সূত্র - পটলডাঙার সেই টেনিদার বয়স এখন ৭৫, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, আনন্দবাজার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫
প্যালারাম ব্যর্থ বাঙালি কিশোরের প্রোটোটাইপ, অভীক মজুমদার, কফি হাউস, সংবাদ প্রতিদিন, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Powered by Froala Editor