পর্যটন কেন্দ্রের সম্ভাবনা-মাখা এক লেপচা বৌদ্ধ মঠের গল্প

পাহাড়ের কাছে কীই-বা চাওয়ার থাকতে পারে! শান্তি, নির্জনতা, গাম্ভীর্য? কোনো এক দার্শনিক বলেছিলেন, পাহাড় হল পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিস্তম্ভ। তার এক কোলে থাম গ্রাম। গ্রামের কাছে আপার ঘাইলেটার। জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গের সিটং-১-এ। প্রাচীন এক বৌদ্ধ বিহার রয়েছে ওই গ্রামে। স্থানীয়রা বলেন, এর বয়স ২০০ বছরেও বেশি।

মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি এই বৌদ্ধ বিহার। লাট মহলদিরাম রোডের পাহাড়ি রাস্তার পাশে হাঁটার পথ, সবুজ গাছপালা ঘেরা। পথের বাঁ ধারে এক্কেবারে নাক বরাবর মান্দার বা পারিজাত ফুল ফুটে। লাল 'স্বর্গীয়' পারিজাতে বসে মধুপান রুফাস সিবিয়া পাখির। মেরুন-কালো-নীল রঙের মিশেলের সুন্দর পাখিটি আমাদের দেখে বিচলিত হল না। দূরে আরও একটি মান্দার গাছেও সমান তালে পাখিদের আনাগোনা। 

এ দিকে, মেঘলা দিন যায় যায়। গোধূলির আলোও প্রায় বের হয়নি। এলিয়ে পড়ছে সন্ধ্যা। ১০০ মিটার ছোট্ট হাঁটার পর নজরে পড়ে বৌদ্ধ মঠটি। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, মঠ কোনটা। মঠটি বাইরে থেকে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরের মতো। এর প্রকৃত নাম আপার ঘাইলেটার লংহো লেপচা বৌদ্ধ মঠ। অনেকেই এই নাম জানেন না। কেউ কেউ একে লেপচা মনাস্ট্রি ডাকেন। কেউ-বা মানা গ্রামের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে মানা মঠও বলেন। অনেকের কাছে থাম মনাস্ট্রি নামেও পরিচিত। 

আরও পড়ুন
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কাঠের নৌকা, ঐতিহ্য সংরক্ষণে বাংলাদেশের হাতিয়ার পর্যটন

আরও পড়ুন
কথা হয় শিসের সুরে, ‘সেরা গ্রামীণ পর্যটনকেন্দ্র’ মেঘালয়ের কোংথং?

মঠের সামনে কয়েকটি চোরটেন বা স্তূপ। চারিদিকে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা পতাকা। হঠাৎই এক বৃদ্ধা আমাদের বললেন, ‘ভিতর নেহি জায়েঙ্গে?’ আমরা ‘বিলকুল জায়েঙ্গে' বলে জুতোজোড়া খুলে আগুয়ান। মাটির মেঝে ধরে ভিতরে যেতেই কে যেন অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলেন, ধর্মের কাছে কী খোঁজো? এর উত্তর শান্তি— হ্যাঁ, শান্তি খুঁজি। এই শান্তি মানে কিন্তু সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়, এই শান্তি বৈষয়িক বিষধর ছোবলের মলম। এত নির্মল ও শান্ত জায়গা বহুদিন পর দেখছি। নির্মল দিনে, যেদিন রোদের সরগম লেখে সূর্য, এই মঠ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াগুলি দেখা যায়। তবে, সেখানে 'গাভীর মতো মেঘ’ চড়তে দেখাও কম সৌভাগ্যের নয়। 

জানলাম, বৌদ্ধ মঠে রূপান্তরিত হওয়ার আগে এটি লেপচা রানি মহল (লেপচা রানির প্রাসাদ) ছিল। এটিই সিটং-এর একমাত্র বৌদ্ধ বিহার। লেপচা বৌদ্ধ সম্প্রদায় যার পরিচালনার দায়িত্বে।

মঠের ভিতরে কেবল একটিই প্রার্থনা-ঘর। সামনে একটি বড় কাচের কেস। ভিতরে প্রধান সোনার মূর্তিটি গুরু রিনপোচের। জানিয়ে রাখি, এই রিনপোচেই কিন্তু গুরু পদ্মসম্ভব। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত হয়ে ৫৪ বছর অতিবাহিত করেন। পদ্মসম্ভব তান্ত্রিক বৌদ্ধ বজ্রযান। এই লেপচা মঠের পদ্মসম্ভবের পাশে একটি ছোটো বুদ্ধের মূর্তি। নিচে বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবতার আরও কয়েকটি ছোট মূর্তি রয়েছে। জ্বলন্ত ধূপকাঠি। আলো-আঁধারি ঘেরা পরিবেশ যেন গভীর ধার্মিকতার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলেছে।

প্রার্থনা ঘরের ভিতরে দু'টি প্রধান স্তম্ভ। একটিতে অদ্ভুত এক মূর্তি। দেবী কালীর মতো দেখতে। অবাক হয়েছি। ধর্মীয় সংস্কৃতি হয়তো এভাবেই মিশে যায়। অন্য স্তম্ভেও শক্তির প্রতীক। চারপাশেও অনেক দেব-দেবী। দেওয়ালে কিছু প্রাচীন ম্যুরাল, রংচটা, আঁকা বা মূর্তি রয়েছে শয়তান বা অসুরও। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা লাগ-না (এক ধরনের বাদ্য, ডাফলির মতো দেখতে), রোলমো (এক ধরনের করতাল)-সহ আরও কিছু। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির উৎসবে এসব ব্যবহার করেন। জায়গাটি কিন্তু আদেশ পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

শুনেছি, মঠে কিছু ধাতব ট্রাঙ্ক বাক্সের কথা। সেখানে লেপচা রানির শাসনামলের কিছু দুর্লভ জিনিসপত্র এবং শিল্পকর্ম সংরক্ষিত। মনে হয়, সংরক্ষিত জিনিসপত্রগুলি রানির আমলেরও বহু আগের। এর মধ্যে রয়েছে সেই যুগের একটি পুরনো তলোয়ার এবং একটি বর্ম। বর্মটিকে ভারী দেখালেও আসলে বেশ হালকা এবং একইসঙ্গে এতটাই শক্তিশালী যে, এটি আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। ওই বৃদ্ধা সংরক্ষিত ষাঁড়ের শিং আমাদের দেখালেন। পুজোয় ব্যবহার হত। বললেন, এখানে পাথরের শিলালিপিও রয়েছে। এভাবেই বেলা ফুরায়। মঠের ভিতরে রাখা দানবাক্স। সেখানে সাধ্যমতো দিয়ে মূল ফটকে পা দিয়েছি, বেরোব, একদল পর্যটক ঢুকলেন। তাঁদের মধ্যে এক মাঝবয়সি মহিলা দীর্ঘকেশী। তাঁর গলায় 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'। বুদ্ধের চরণে প্রণাম। তাঁর কাছে পর্যটক নয়, পরিব্রাজক যাপন কি আমরা চাইতে পারি?

Powered by Froala Editor