কলকাতাতেই যাত্রা শুরু ভারতের প্রথম ব্রডকাস্টিং কোম্পানির

সেন্ট জনস চার্চের বিপরীতে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট। একটা সরু গলি ওই রাস্তায়। এখানকার বহু পুরনো এক বিল্ডিং বরাবরই বেশ জনপ্রিয়। কখনো হাসপাতাল, কখনো অফিস, কখনো-বা স্টেশন হিসাবে বিল্ডিংটির সুখ্যাতি। সতেরো শতকের মাঝামাঝি হাসপাতাল ছিল ১নং গার্স্টিন প্লেসের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির মালিকানাধীন ভবনটি। কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত এই রাস্তার সমস্ত প্রতিবেশী বিল্ডিংকেও পথচারীরা বলতেন ‘গার্স্টিন বিল্ডিং’ (Garstin Building)। পরবর্তীতে মধ্য কলকাতার এই বিল্ডিংটিই অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর (All India Radio) অফিস।

বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের মেজর জেনারেল জন গার্স্টিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের। ১৭৮৪ সালে ভারতে 'নবজাতক' ব্রিটিশ প্রশাসন ক্যাপ্টেন জন গার্স্টিনকে পাটনার বাঁকেপুর এলাকায় প্রথম সরকারি শস্যভাণ্ডার নির্মাণের দায়িত্ব দেয়। ব্রিটিশরাজকে হতাশ করেননি গার্স্টিন। পটনার ফ্রেজার রোডে যে 'গোলঘর', তা সে-সময় গার্স্টিনেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ অনাহারের শিকার। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং গোলঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৭৮৪-র ২০ জানুয়ারি, শস্য (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য) সংরক্ষণের জন্যই এই বৃত্তাকার কাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু জন গার্স্টিনের। ১৭৮৬ সালের ২০ জুলাই গোলঘরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ১৪০,০০০ টন শস্য সংরক্ষণ করতে পারে এই 'গোলঘর'।

১৭৯২ সালে গার্স্টিন ওল্ড কোর্ট হাউস ধ্বংসের তত্ত্বাবধান করেন। তিনি সেন্ট জনস চার্চের উত্তর দিকের ভবন নির্মাণের জন্য ওল্ড কোর্ট হাউসের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী পুনরায় ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর নামে ওই ভবনগুলোর নামকরণ করা হয় গার্স্টিন হাউস। এরপর ব্রিটিশ সরকারের গুডবুকে ঢুকে পড়েন তিনি। বাংলার সার্ভেয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৮০৮ থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮২০-র ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন গার্স্টিন। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রিতে চিরশয্যায় তিনি। পরবর্তীতে কলকাতা পুরসভা এলাকাটি দখল নেওয়ার পর রাস্তার নাম হয় গার্স্টিন প্লেস।

এক সময় গার্স্টিন প্লেসের বিল্ডিংটি ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির (আইবিসি) প্রধান অফিস ছিল। বিবিসি-র আদলে প্রতিষ্ঠিত, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভারতীয় সম্প্রচার সংস্থা ভারতের প্রথম সম্প্রচার স্টুডিয়ো। তারা প্রথম রেডিয়ো স্টেশন শুরু করেন ১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই, বোম্বের অ্যাপোলো বান্ডার রোডে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড আরউইন এই রেডিয়ো স্টেশনের উদ্বোধক। যাই হোক, শীঘ্রই তারা কলকাতা হাইকোর্টের বিপরীতে টেম্পল চেম্বারে তাদের 'কলকাতা স্টেশন' খোলেন। এরপর সেই অফিস ১নং, গার্স্টিন প্লেসে চলে যায়। ১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি কলকাতায় প্রথম বেতার সম্প্রচার শুরু করে। ফলে, কলকাতাতেই ভারতের প্রথম ব্রডকাস্টিং কোম্পানি হিসাবে যাত্রা শুরু করে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো। 

আরও পড়ুন
‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ এখন শুধুই ইতিহাস, চাঞ্চল্য অনুরাগীদের মধ্যে

১৯৩৬ সালের জুনে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার পরিষেবার নাম পরিবর্তন করে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো রাখা হয়। একই বছর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর মাধ্যমে প্রথম সংবাদ বুলেটিন সম্প্রচারিত। কলকাতা রেডিয়ো স্টেশনের প্রথম পরিচালক বিবিসির সিসি ওয়ালিক। নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার সমগ্র অনুষ্ঠানের প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন। গার্স্টিন প্লেসের অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর কলকাতার প্রথম অফিস ১৯৬১ সালে ইডেন গার্ডেনের কাছে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত। ততদিনে অবশ্য অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর নাম আকাশবাণী (১৯৫৬) রাখা হয়ে গিয়েছে। তখন থেকেই সর্বভারতীয় রেডিয়ো নতুন আকাশবাণী ভবনে কাজ শুরু করে। বর্তমানে সর্বভারতীয় রেডিয়ো বিশ্বের বৃহত্তম মিডিয়া সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র হিন্দিতেই সম্প্রচার, অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কোপে বাংলা সহ ১২টি ভাষা

১নং গার্স্টিন প্লেসে কলকাতার প্রথম রেডিয়ো অফিসটি বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলে অবস্থিত ছিল। প্রথম তল মদ ব্যবসায়ী, এক 'গোরা সাহেব'-এর নামে। কয়েক বছর পর মদের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো পুরো বিল্ডিংটির দখল নেয়। পুরনো ভিক্টোরিয়ান-শৈলীর বিল্ডিংয়ের সিঁড়িগুলি কাঠের তৈরি।

তখন অনুষ্ঠানগুলির সম্প্রচারের সময়সীমা প্রতি সন্ধ্যায় তিন-চার ঘণ্টা। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সিগনেচার টিউন তৈরি হয় জন ফোল্ডসের হাতে। বেহালা, ভায়োলা, ছেলো ও তানপুরার সংমিশ্রণে তৈরি এই টিউন। সুরের সময়সীমা ছিল আট সেকেন্ড।

ঐতিহাসিক এই ভবন থেকে এককালে সম্প্রচারিত হয়েছে ‘বিরূপাক্ষের আসর’, ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বহু স্বনামধন্যের স্মৃতিধন্য শহরের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত এই বেতার অফিস। যদিও নতুন এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর জনশূন্য হয়ে পড়ে গার্স্টিন প্লেসের এই কার্যালয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই স্মৃতিসৌধ ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভেঙে ফেলা হয়। শেষ হয় ইতিহাসের একটি অধ্যায়।

Powered by Froala Editor