জীবনের প্রথম ছবি হিসেবে একটি গাধাকে বেছেছিলেন রঘু রাই

১৯৭১। ভারত তো বটেই, এশিয়া মহাদেশ-সহ গোটা বিশ্ব এই সময়টির মাহাত্ম্য হয়তো কোনদিন ভুলতে পারবে না। ষাটের দশক থেকেই একটা প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছিল সমস্ত জায়গায়। তারই একটা অংশ চূড়ান্ত রূপ পেল পূর্ব পাকিস্তানের বুকে। বাঙালিদের সম্মিলিত লড়াই, বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের লড়াই গোটা পৃথিবীকে থমকে দিয়েছিল। একদিকে পাকিস্তানি সেনা-হানাদারদের বর্বর অত্যাচার, হাজার হাজার মানুষের অসহায় জীবন; অন্যদিকে সেই ধুঁকতে থাকা মানুষদের পাল্টা প্রতিবাদের চিত্র। গোটা বিশ্বের সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেখানে। ঘুরছেন তিরিশ বছরের এক তরুণ ভারতীয় আলোকচিত্রীও। কাদা মেখে, চোরকাঁটা বিঁধে একাকার; তবুও থামছেন না তিনি। তাঁর ক্যামেরা খুঁজে চলেছে উদ্বাস্তু দরিদ্র বাঙালির মুখ। রঘু রাই জেগে উঠছেন; তাঁর ক্যামেরা তুলে ধরছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রূপ…

একটু কি বড়ো হয়ে গেল ভূমিকাটা? হয়তো বা। কিন্তু সময়টা একবার ভাবুন। বাংলাদেশের বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি; অন্যদিকে একা কুম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রঘু রাই। আটাত্তর বছরের জীবন্ত কিংবদন্তি। ভারতের ফটোগ্রাফিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর চোখ কত মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে। সাক্ষী থেকেছে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। অবিভক্ত পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া এক তরুণ সেই সময় মিলে গিয়েছিলেন স্রোতে। কি অদ্ভুত ব্যাপার, রঘু রাইয়ের আলোকচিত্রী জীবনেরও পঞ্চাশ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে আগেই। অবশ্য ক্যামেরা থামেনি তাঁর, এখনও…

পরিবার ও পরিস্থিতির জাঁতাকলে পড়ে চলে গিয়েছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জীবনে। ছক বাঁধা জীবন তখন, দিল্লিতে একটা জায়গায় চাকরিও পেলেন। কিন্তু রঘুনাথ রাই চৌধুরী তো এমন জীবন চাননি। চোখের সামনে দেখছেন নিজের দাদা, শরমপাল চৌধুরীকে। এস পাল নামে যিনি ততদিনে একটু হলেও নাম করে ফেলেছেন। ব্যস, সেখান থেকেই রঘু রাইয়ের রক্তে মিশল ফটোগ্রাফি। দাদাকে গিয়ে বললেনও সেই কথা। ভাইয়ের এই উৎসাহ দেখে এস পাল তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন এক বন্ধুর কাছে। আপাতত কারোর সঙ্গে থেকে কাজ দেখুক, একটু একটু করে এগোক… 

দাদার সেই বন্ধুর সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্রামে চলে গেলেন রঘু রাই। ততদিনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন। কথা ছিল, ওই গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের ছবি তোলা হবে। কিন্তু রঘু রাইয়ের সেদিকে মন নেই। তাঁর চোখ তখন খুঁজে নিয়েছে একটি গাধাকে। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সে। পড়ে রইল কাজ, রঘু রাই এই গাধাটিরই ছবি তুলবেন। কিন্তু কাছে যেতেই, সে পালিয়ে গেল আরও দূরে। তিনি ছুটে ছুটে গেলেন, আবার পালিয়ে গেল। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলল সেই দৌড়ঝাঁপ। এদিকে রঘু রাইয়ের এমন কাণ্ড দেখে আশেপাশের বাচ্চারা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেই ছবিটা তোলা হল। সেটি পাঠানো হল লন্ডনের টাইমস ম্যাগাজিনে। এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম, ছবিটি ছাপাও হয়ে গেল! 

১৯৬৫ সাল। কলকাতায় স্টেটসম্যানের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবে জীবন শুরু হল রঘু রাইয়ের। সেই যে পা রাখলেন এই শহরে, এই বাংলায়; এক আত্মিক যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেল। শহরের নাড়ির গন্ধ পেয়ে গেলেন রঘু রাই। তারপর কিংবদন্তি ফটোগ্রাফার হেনরি কার্টার ব্রেসনের সঙ্গে আলাপ, তাঁরই সুপারিশে ম্যাগনাম ফোটোসে যুক্ত হওয়া— সে এক ইতিহাস। রঘু রাইয়ের ইতিহাস। সময় যত এগিয়েছে, তাঁর ক্যামেরা ধরে আমরাও চিনতে শিখেছি ভারতকে, এবং সমকালীন পৃথিবীকে। মনে করুন একাত্তরের সেই ছবিগুলো— দীর্ণ, রিক্ত এক বৃদ্ধার মুখ, যার মুখের প্রতিটি রেখা জানিয়ে দিচ্ছে তাঁর মতো আরও অসংখ্য মানুষের অবস্থার কথা। কিংবা, লাইন ধরে হেঁটে আসছে শরণার্থীর দল। রঘু রাইয়ের সেসব ছবিতে যেন শোনা যাচ্ছে ওঁদের পায়ের শব্দ, ভারী বুটের আওয়াজ, আর্তনাদ ও প্রতিবাদের মন্ত্র… 

আজ থেকে ৩৬ বছর আগের একটি অধ্যায়। এরকমই এক ডিসেম্বরের রাত। ভোপালের মানুষরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। হঠাৎ চিৎকার, আর্তনাদ, রাস্তা জুড়ে মিছিল। সবার মুখে কাপড়; কেউ কেউ তো অজ্ঞান হয়ে পড়েও যাচ্ছেন। এ কি! চোখ মুখ যে জ্বলছে! নিঃশ্বাসও নেওয়া যাচ্ছে না… তারপর আর কারোর কিছু মনে নেই। পৃথিবী দেখেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক ইন্ডাস্ট্রিয়াল দুর্ঘটনা; অপরাধ বললেও কম বলা হয় না। রঘু রাই তখন প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার; ইন্ডিয়া টুডে’র আলোকচিত্রী বিভাগের ডিরেক্টর। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পরদিনই চলে গেলেন অকুস্থলে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ, পশু, পাখির মৃতদেহ। যেন কিছুক্ষণ আগে যুদ্ধ হয়ে গেছে এখানে। 

আরও পড়ুন
হুইলচেয়ারে বসেই ফটোগ্রাফি, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রতিবন্ধকতা জয় খড়গপুরের শুভ্র-র

ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই থমকে গেলেন রঘু রাই। দেখছেন একটি শিশুর কবর। একরত্তি শিশু, কতই বা বয়স তার। বিষাক্ত গ্যাস তাকে দেখতে দিল না পৃথিবীর আলো। আশেপাশে মাটি, পাথর; তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আছে শিশুটির মৃত, অন্ধ একটি মুখ। বীভৎস দুটো চোখ। রঘু রাই ছবি তুললেন; সেই ছবি আজ গোটা বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবির তকমা পেয়েছে। ওই একটি ছবি যেন ভোপালের ‘হত্যালীলা’র স্বরূপ তুলে ধরল… 

রঘু রাই কেবল ছবি তোলেন না, তাঁর ক্যামেরা কথা বলে। তিনি বিশ্বাস করেন, একটি ছবির সঙ্গে যদি শিল্পীর আত্মা না জড়িয়ে থাকে তাহলে সেটা সম্পূর্ণ হয় না। এটা তো খুব অল্প কথা। রঘু রাইয়ের ছবি নিজেই একটি দর্শন। তাঁর হাত ধরে ভারতের জনজীবন উঠে আসে আমাদের সামনে। সেখানে লেগে থাকে ইতিহাস, লেগে থাকে চেতনা। প্রায় আয়না হয়েই আমাদের সামনে চলে আছে তারা। রঘু রাই সেই আয়নারই কারিগর…           

তথ্যসূত্র-
১) ‘রঘু রাই-এর ক্যামেরায় ১৯৭১’, আন্দালিব রাশদী, দৈনিক ইত্তেফাক
২) ‘Raghu Rai: Interview’, Elizabeth Day, The Gurdian
৩) ‘Bhopal Gas Tragedy: Veteran Photojournalist Raghu Rai Describes How ‘Corporate Crime’ Looked Like 34 Years Ago’, Kriti Gupta, India Times 

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে ‘ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার’ সম্মান তরুণীর

Powered by Froala Editor

More From Author See More