হুইলচেয়ারে বসেই ফটোগ্রাফি, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রতিবন্ধকতা জয় খড়গপুরের শুভ্র-র

“একবার বেরিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে এনেছিলাম।। তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ছবি তোলায় একটা লম্বা গ্যাপ হয়ে গিয়েছিল সেবার। তুলে আনা ছবিগুলো এডিট আর পোস্ট করতে করতেও শেষ হয়ে এসেছিল ভাঁড়ার। হাতে কোনো কাজ ছিল না। সেদিন ব্ল্যাঙ্ক লাগছিল খুব। তো কী করা যায় ভাবতে ভাবতে চেয়ারে বসেই নিজের চারিদিকে একপাক ঘুরলাম। খানিকটা করে ঘুরছি আর সামনে যে ফ্রেমটা আসছে, সেটারই ছবি তুলছি একটা করে। এরমভাবে বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পর যখন ছবিগুলো নিয়ে বসলাম, দেখলাম একটা অন্যগল্প উঠে এসেছে। আমার খাটের পাশেই একটা জানলা। সেখানে প্রতিদিনই পর্দা ঝোলানো থাকে একটা। সেদিনও ছিল। জানলা দিয়ে আলো আসছিল, আর গুটিয়ে রাখা পর্দাটা যেন একটা পায়রা হয়ে উড়ে যেতে চাইছিল জানলার গরাদ ভেঙে...”

বলছিলেন ফটোগ্রাফার শুভ্র ঘোষ। তবে আর পাঁচ জনের মতো চাইলেই বেরিয়ে পড়তে পারেন না তিনি ক্যামেরা হাতে। আর পাঁচজনের মতো চাইলেই সুন্দর কোনো দৃশ্যপটের সামনে হাজির হয়ে ছবি তুলতে পারেন না তিনি ইচ্ছেমতো। ক্যামেরা আর নিজের দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়াও ছবি তোলার জন্য যাঁকে নির্ভর করে থাকতে হয় হুইলচেয়ারের ওপর। তবে ওই যে। কথায় আছে, ইচ্ছেশক্তির কাছে বাধ সাধতে পারে না পাথরও। তেমনই সমস্ত প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করেই আলোকচিত্রের সঙ্গেই ঘর বেঁধেছেন শুভ্রবাবু।

বছর সাড়ে চার-পাঁচ আগে ফটোগ্রাফির হাত ধরা আকস্মিকভাবেই। বলা যেতে পারে এটাই হয়তো ভবিতব্য ছিল তাঁর। পাড়ার বন্ধুদের থেকে দীঘা যাওয়ার প্রস্তাব এসেছিল হঠাৎ করেই। তার আগে বাড়ি থেকে দীর্ঘ কয়েক বছরই বেরোননি তিনি। পরিচিত বলতে পরিবার আর চার দেওয়াল। তবে সেই প্রথম দীঘা যাওয়ার প্রস্তাবে সায় দিলেন তাঁর বাবা-মা। কেনা হল হুইলচেয়ারও। আর সঙ্গ দিল বহুদিন আগের কিনে রাখা এক ক্যামেরা। নিজের আঁকা ছবি তোলার জন্য নিছকই সেই ক্যামেরা কিনেছিলেন শুভ্রবাবু।

প্রথমবার যেন মুক্তির স্বাদ। দীঘার পথে যেতে যেতে হুইলচেয়ারে ভর করেই বেশ কিছু ছবি তুলে এনেছিলেন শুভ্রবাবু। যার প্রায় সব ছবিতেই সাধারণ দৃশ্যপটের মধ্যেই বোনা আছে কিছু অন্যরকম গল্প। তবে তখনও ফটোগ্রাফির কথা সেইভাবে জাঁকিয়ে বসেনি মনে। “তারপর আবার যখন ফিরে এসে ঘরে টাইম কাটানো শুরু করলাম, তখন অঢেল সময়। কম্পিউটার টেবিলেই এটা-সেটার ছবি তুলতাম মোবাইলের ক্যামেরাতেই। অনেকটা ম্যাজিকের মতোই হয়েছিল ব্যাপারটা। কোনো অবজেক্টের মধ্যেও তখন লাইফ খোঁজার চেষ্টা করতাম সেই সময়ে”, বলছিলেন শুভ্রবাবু।

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে ‘ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার’ সম্মান তরুণীর

তবে আলাদা করে কারোর কাছেই ছবি তোলা শেখেননি তিনি। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, পছন্দের ফটোগ্রাফির জগতকে এক্সপ্লোর করার জায়গা হয়ে উঠেছিল ফেসবুক। ফেসবুকের দৌলতেই জুটেছিল বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব। নিজের তোলা ছবি প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্যের ছবি দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, সবটার জন্যই জায়গা করে দিয়েছিল ফেসবুক। শুভ্রবাবু জানালেন, “ফেসবুকেই আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এক দিদির। সেই দিদিই আমাকে প্রথম ভরসা দিয়েছিলেন, যে কিছু করে উঠতে পারব আমি ফটোগ্রাফিতে। দিদির অনুপ্রেরণা ছাড়া এসব কোনোদিনই সম্ভব হত না”। 

ধীরে ধীরে ছবি তোলার পরিধি বাড়তে থাকে সেখান থেকেই। কথায় কথায় উঠে আসে, “মাস দুয়েক ছাড়া ছাড়া আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় চেক-আপের জন্য। আসা যাওয়ার পথে যেটুকু সময় মেলে সেই সময়টাতেই আমি ছবি তুলি বাইরের। আর তাছাড়া আমার এক ভাই আছে, সে অফিসের ছুটিতে বাড়ি ফিরলে ছবি তুলতে বেরোই ওর সঙ্গে। খড়গপুরের আশে-পাশে যেসব গ্রাম আছে সেখানে ছবি তুলতে যাই গাড়ি করে। এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছি ফটোগ্রাফি। আগামীতেও এইভাবেই ছবি তুলব।”

আরও পড়ুন
ছবি তুলতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন যেসব ফটোগ্রাফার

তবে অধিকাংশ সময়ই যাতায়াতের মাঝে গাড়ির ভেতর থেকেই ছবি তোলা। চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ফ্রেম। শান্ত হয়ে ক্যামেরা সেট করার সুযোগ নেই কোনো। কাজেই নিজেকে শুভ্রবাবু তৈরি করেছেন পরিস্থিতির মতো করে। যতটুকু সময় পাওয়া যায় সেই মুহূর্তের মধ্যেই এক ক্লিকে ফ্রেমবন্দি করা কোনো দৃশ্যকে। এমনই এক ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই একেকটা বাইরে বেরনোর মধ্যেই তৈরি হয় বেশ কিছুদিনের অন্তর। সেই সময়টাতেও চলে এক অন্য ধরণের ফটোগ্রাফি। ঘরে মধ্যে বসেই যেমন নানান জিনিসের ছবি তোলেন শুভ্রবাবু, তেমনই পুরনো ছবির মধ্যে থেকেও নতুন কোনো গল্পের অনুসন্ধান করেন তিনি। “আমার তোলা বেশ কিছু পোট্রেট ছবিকে ল্যান্ডস্কেপ করে করে দেখেছি ইদানীং সময়ে। দেখেছি সেখান থেকে অন্য কোনো গল্প উঠে এসেছে। বা আগের তোলা ছবির কন্ট্রাস্ট, কালার চেঞ্জ করলেও পুরোপুরি বদলে গেছে ছবিটার অর্থ।” বাইরে না বেরিয়েও এভাবেই ফটোগ্রাফি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

তবে দু’দশক আগে পরিস্থিতি একেবারেই এমনটা ছিল না শুভ্রবাবুর। রীতিমতো একজন স্পোর্টসপার্সন ছিলেন তিনি। তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্স, প্রথম ধরা দিয়েছিল অজানা এক অসুখ। অজান্তেই যে বাড়ছিল জুভেনাইল রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, তা বুঝতে পারেননি স্থানীয় চিকিৎসকরাও। দীর্ঘদিন ধরেই চলে গেছে ভুল চিকিৎসা। প্রথমে পায়ের একটা আঙুল, তারপর গোড়ালি, হাঁটু, বিভিন্ন জয়েন্টগুলোই অচল হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সেইসঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। চিকিৎসকরা বলেছিলেন কৈশোর বয়সে এমন হাড় বাড়ার জন্য সমস্যা দেখা দেয়। সময় গড়ালেই ঠিক হয়ে যাবে সব। শেষ অবধি আসল ব্যধিকে চিহ্নিত করেছিলেন ভেলোরের চিকিৎসকরা। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। পার্মানেন্ট ডিফর্মেশন। স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ক্লাস সেভেনেই। প্রিয় আঁকাকেও বিদায় জানাতে হল হাতের আঙুলের শিথিলতার জন্য। 

আরও পড়ুন
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি – হুজুগ, নিষ্ঠা ও কিছু বিপন্ন বন্যপ্রাণের গপ্পো

তার পরের বছরগুলো কেটেছিল সম্পূর্ণ চার দেওয়ালের মধ্যেই। পড়াশোনারও সুযোগ হয়নি সেভাবে। বাড়িতে বসেই প্রাইভেট টিউটরের থেকে শেখা ফটোশপ এবং অন্যান্য কম্পিউটারের কাজ। ব্যাট-বল, রং-তুলির জায়গায় ধরা মাউস, কী-বোর্ড। বাড়িতে বসেই কাজ শুরু করেন এক স্টুডিয়োর। ছবি এডিট, বিভিন্ন সৃজনী প্রস্তুত— এসবের মধ্যেই কাটছিল দিন। তারও অনেক অনেক বছর পর ফেসবুক আর ক্যামেরা একেবারেই বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। স্কুলের বন্ধুরা অবশ্য ততদিনে অনেক দূরগ্রহের প্রাণী। নিজে আবার আলাপ করতে গিয়েও ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। বুঝেছিলেন সবকিছুই বদলে গেছে তাঁর। সেই শূন্য থেকেই নতুন করে শুরু করেছিলেন তিনি আবার। আর ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছেন ফটোগ্রাফিকে। তা নিয়েই বাকি জীবন থাকতে চান শুভ্রবাবু। লড়ে যেতে চান নিজের এই লড়াই।

তবে এখনও পর্যন্ত কোনো কম্পিটিশন কিংবা এগজিবিশনে কখনও ছবি দেননি শুভ্রবাবু। পছন্দ করেন না সেসব তিনি একেবারেই। কেবলমাত্র দুটি সংস্থার সম্মাননা সম্মেলনের আমন্ত্রণে হাজির হয়েছিলেন তিনি। কিন্ত অন্য এক স্বপ্ন দেখেন শুভ্রবাবু। দেখেন একদিন নিজেই আয়োজন করবেন একটা এগজিবিশনের। “আমি বিভিন্ন জায়গায় যখন ছবি তুলতে যাই— খুব কিছু বড়ো জায়গায় তো যাই না। তবে যেখানেই যাই অলি-গলিতে ঢুকে ছবি তুলি, সেখানকার গল্প খুঁজি। সেখানেই অনেক ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের দেখি। আমার বিশ্বাস ওদের হাতে একটা সাধারণ ক্যামেরা বা মোবাইল ধরিয়ে দিলেও দশজনের মধ্যে তিনজন এমন কিছু ছবি তুলে দেবে যা মাস্টারমাইন্ড। কোনো বড়ো ফটোগ্রাফার না, এমনই সাধারণের তোলা ছবি নিয়েই একটা এগজিবিশন করার ইচ্ছে আছে আমার। তবে তার জন্য সময় দরকার অনেকটাই”, বলছিলেন শুভ্রবাবু। 

একদিন সে ইচ্ছে পূরণ হবে, তা নিশ্চিতই। আর তার জন্যই সমস্ত প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে অদম্য জেদেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শুভ্রবাবু। খুব কিছু দামি ক্যামেরা নয়, শক্তিশালী লেন্স নয়, সুন্দর প্রকৃতি কিংবা সাজানো দৃশ্যপটও নয়— মানুষের জীবনের গল্প, সাধারণের মধ্যে থেকেই অসাধারণকে খুঁজতে শেখাচ্ছেন শুভ্রবাবু। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সবার হাতেই প্রায় চলে এসেছে স্মার্টফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা। সকলেই নিজেকে দাবি করছেন ফটোগ্রাফার হিসাবে। একজনের তোলা ছবির অনুকরণেই লেন্সবন্দি করা হচ্ছে হাজার হাজার ছবি। এমনই এক ফটোফোবিক আবহে দাঁড়িয়ে যেন অন্য রূপকথারই সন্ধান দিচ্ছেন তিনি। তরুণদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগাচ্ছেন নতুন কিছু খুঁজে দেখার। একই ফ্রেমে বারবার চোখ রেখে অন্য অন্য গল্পের অনুসন্ধানের। এটাই তো একজন প্রকৃত শিল্পীর দায়িত্ব...

Powered by Froala Editor

More From Author See More