১৯৭৭ সাল। সুইৎজারল্যান্ডের লেক জেনিভার কাছে, পাহাড়তলীর কর্সিয়র-সার-ভেভেই সমাধিক্ষেত্র থেকে চুরি যায় একটা মৃতদেহ। সেই মরদেহের অধিকারী যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিন। চ্যাপলিন মারা গেছিলেন ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে। মৃত্যুর মাত্র দু’মাসের মধ্যেই তাঁর শবদেহ সিমেট্রি থেকে চুরি যায়।
এর পরেই চ্যাপলিনের পত্নী উনা একটা উড়ো ফোন পান। সেই ফোনে দেহ ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৬ লক্ষ ডলার দাবি করে অপহরণকারীরা। যদিও উনা সেই ফোনকে একদমই পাত্তা দেননি। বরং জানিয়ে দেন, চার্লি এটা জানলে হেসে লুটোপুটি খেতেন।
তবে পুলিশকে জানানোর পর ছুটে আসে বিশ্বের মিডিয়া। নিন্দার ঝড় ওঠে। কারণ শবদেহ তো আর যার তার নয়! সবাই সমাধিক্ষেত্রে ছুটে গিয়ে দেখে, সেটা কারা খুঁড়ে রেখেছে। এবং অবশ্যই সমাধি থেকে চার্লির শবদেহ কফিন সমেত উধাও।
কেউ রটায়, এতে আমেরিকার হাত আছে। কেননা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চ্যাপলিন বরাবর বিষোদগার করেছেন। আমেরিকা চ্যাপলিনকে কমিউনিস্ট আর রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করত। একদম পছন্দ করত না। এমনকি, লন্ডনে লাইমলাইট ছবির প্রিমিয়ারে গিয়ে আর আমেরিকায় ফিরতে পারেননি চ্যাপলিন। রি-এন্ট্রি ভিসাই দেয়নি আমেরিকা।
তদন্তে নেমে প্রায় প্রায় ২০০ টেলিফোন বুথে আড়ি পাতে পুলিশ। ওদিকে শবদেহ অপহরণকারীরা আবার চার্লির স্ত্রীকে ফোন করে। বলে, টাকা না দিলে চার্লি আর উনার নাবালক দুই সন্তানকে মেরে ফেলা হবে। এ বার কিন্তু সত্যিই ভয় পেয়ে যান উনা।
পুরো সুইৎজারল্যান্ড জুড়ে বিশাল তল্লাশি করে পাঁচ সপ্তাহ পর পুলিশ পোল্যান্ডের রোমান ওয়ার্ডাস আর বুলগেরিয়ার গানস্ক গানেভ নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে। এরা পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা দুই রাজনৈতিক রিফিউজি আর পেশায় অটো মেকানিক। তারা পুলিশকে একটা ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে যায়। সেখানে তারা চ্যাপলিনের দেহটি মাটির তলায় পুঁতে রেখেছিল।
মূল চক্রান্তকারী ওয়ার্ডাসকে সাড়ে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর গানেভের হয় ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড।
চ্যাপলিনের দেহ পুনরায় সমাহিত করা হয় সেই একই সমাধি ক্ষেত্রে। তবে, এবার সমাধিটা কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়।
হঠাৎ করে ধনী হওয়ার বাসনায় যেমন মৃতদেহ চুরি হতে পারে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের দেহ কবর থেকে তুলে ফের তাদের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠার প্রথাও আছে এই বিশ্বে।
কবর থেকে মৃত আত্মীয়-বন্ধুদের কঙ্কাল তুলে, তাদের চুল আঁচড়ে নতুন জামা পরিয়ে নতুন করে সাজিয়ে আবার কফিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। সেরকমও কিন্তু হয়!
ইন্দোনেশিয়ার টুরাজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রত্যেক তিন বছর অন্তর মৃত প্রিয়জনদের কবর থেকে তুলে এনে খুব যত্ন করে, ভালবেসে তাদের মেক ওভার করা হয়। প্রথমে মৃতদেহ ধুয়ে মুছে সাফ করা হয়। তারপর চুল পাট করে আঁচড়ে দিয়ে কিংবা নতুন জামা পরিয়ে ফিটফাট করে সবার সামনে নিয়ে আসা হয়। কাউকে আগের মতোই চশমা পরিয়ে দেওয়া হয়, কাউকে কেতাদুরস্ত জামা। কারুর মুখে আবার গুঁজে দেওয়া হয় সিগারেট। তাঁদের দেহের সঙ্গে সবাই ছবিও তোলে। এই প্রথার মাধ্যমে মৃত প্রিয়জনদের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা জানায় ওরা।
এর নাম 'মানেনে' উৎসব। ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের এই সম্প্রদায়ের মানুষজন মৃত প্রিয়জনদের সাজানোর পর তাঁদের সঙ্গে একই ফ্রেমে ফ্যামিলি ফটো তোলেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই উৎসব পালন করলে তাদের জীবন মঙ্গলময় হবে।
মৃত্যুর পরের শেষকৃত্য ওঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনেকেই সারা জীবনের আয় থেকে বেশ খানিকটা টাকা জমিয়ে রাখেন, যাতে মৃত্যুর পর ভালো করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজনে কোনোরকম খামতি না থাকে। বেশ কয়েকদিন ধরে অন্ত্যেষ্টি চলে। মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য মহিষ বা শুয়োর বলি দেওয়া হয়। বলি দেওয়া সেসব জন্তুর শিং ঝুলিয়ে রাখা হয় মৃত ব্যক্তির বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনে শিং এর সংখ্যা যত বেশি হবে, মৃত ব্যক্তির সম্মানও তত বাড়বে।
বলা হয় একবার এক পশু শিকারি পং রুমাসেক শিকার করতে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। পাহাড়ে একটা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে তিনি তা সঙ্গে করে নিয়েও আসেন। তারপর সেটাকে নিজের জামাকাপড় পরিয়ে দেন। টুরাজন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, এরপরই নাকি পং সেই মৃত ব্যক্তির আশীর্বাদে বিশাল সম্পদ আর ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছিলেন। তারপর থেকেই এই উৎসব পালন করা হয়।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়ম কিন্তু আলাদা। তাদের ক্ষেত্রে কফিন বানিয়ে কবর দেওয়া হয় না। দাঁত ওঠার আগে কোনো শিশু মারা গেলে তাকে কাপড়ে পেঁচিয়ে গাছের গুড়ির মধ্যে গর্ত করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
আপাতদৃষ্টিতে আনন্দের হ'লেও এর মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে গভীর এক দুঃখ। অস্তিত্ব কি মানুষের দেহসর্বস্বই? মৃত্যুর পরেও দেহের এতটা কদর থাকে?
Powered by Froala Editor