কোপেনহেগেনে সেরার সেরা ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’, বাংলা গানেই হৃদয় জিতলেন রুমা

১৯৫৮ সাল। বাংলার সংস্কৃতি জগত তখন সোনার খনি। ভারতের তাবড় পরিচালক, অভিনেতা, গায়ক, সুরকারদের জন্মস্থল এখানে। এখানেই জন্মেছেন সলিল চৌধুরী। মনে পড়বে চল্লিশের দশকের কথা। গণনাট্যের হাত ধরে মানুষ শুনল এক অন্য ধারার বাংলা গান— গণসঙ্গীত। ঠিক সিনেমার নয়; এই গান বরং আরও উদাত্ত। ’৫৮-তে এসে সেই গণসঙ্গীত একটু যেন পেছনে সরে যাচ্ছিল। এমন প্রেক্ষাপটেই হাজির হল একটি দল। নাম ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’। চমকে গেল বাংলা-সহ গোটা ভারত। দলগত সঙ্গীত এবং কয়্যার অধ্যায়ের যেন নতুন সূত্রপাত হল। ফিরে এল জনগণের গান, গণসঙ্গীত। আর সেইসবের মাঝে কাণ্ডারি হয়ে থাকলেন এক বাঙালি যুবতী— রুমা গুহঠাকুরতা।

ততদিনে তিনি নিজেও পরিচিত হয়েছেন সিনে জগতে। ছোটো থেকেই শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়েছেন রুমা। মা সতী ঘোষ ছিলেন গায়িকা; সম্পর্কে বিজয়া রায়ের আপন দিদি। শুরুটা অবশ্য অভিনয় বা গানের ভেতর দিয়ে হয়নি; হয়েছে নাচের ছন্দে। তখন রুমা গুহঠাকুরতার সাত বছর বয়স। মায়ের সঙ্গে গেছেন আলমোড়া। তখন সেখানে নিজের নাচের অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যস্ত উদয়শঙ্কর। ব্যক্তিগতভাবে তিনি চিনতেন সতী ঘোষকে। উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্করের বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি গানও করেন। সেইসূত্রে ছোট্ট রুমাকেও স্নেহ করতেন তিনি। সেখান থেকেই আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর কালচারাল সেন্টারে ভর্তি হন রুমা গুহঠাকুরতা। শুরু হয় নাচের প্রশিক্ষণ। উদয়শঙ্করের সঙ্গেই নাচের শো করতে চলে আসেন মুম্বাই। তারপরই জীবনের গতিপথ বদলে যায়… 

বম্বে টকিজ তখন রীতিমতো রাজত্ব করছে বলিউডে। সেই সময়ই নাচের সূত্রে মুম্বইতে চলে আসেন রুমা। তখনই তিনি নজরে পড়েন দেবিকা রানির। দশ বছরের ছোট্ট রুমাকে মনে ধরে তাঁর। ঠিক করেন, বম্বে টকিজের অভিনেত্রী হিসেবে জায়গা দেবেন এঁকে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল নিয়তির খেল। ১৯৪৪ সালে প্রথমবার ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন’-এর জগতে নামেন রুমা। ছবির নাম ‘জোয়ার-ভাটা’, পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী। কেবল রুমা গুহঠাকুরতাই নন; এই ছবির হাত ধরে আরও একজনের অভিনয় জীবন শুরু। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং দিলীপকুমার… 

অভিনয়, নাচের সঙ্গে ততদিনে তাঁর বৃত্তে ঢুকে পড়েছে গানও। মা তো আগে থেকেই গাইতেন; তাঁর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর আব্দুল রেহমান খাঁ, লক্ষ্মী শঙ্কর থেকে শুরু করে দেবব্রত বিশ্বাস— সবার কাছে তালিম নিয়েছেন তিনি। ধীরে ধীরে তৈরি হয় গানের নিজস্ব মানচিত্র। সেখানেই প্রবেশ করেন আরও একজন মানুষ— আভাসকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। কালে কালে যার পরিচয় হবে ‘কিশোর কুমার’ নামে। মুম্বাইতেই আলাপ, প্রেম; এবং ১৯৫২-তে বিবাহ। তখনও বাংলা সিনেমায় দেখা যায়নি রুমা গুহঠাকুরতাকে। কিন্তু চালচিত্রটা তৈরি হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। 

১৯৫৮। দীর্ঘ ছয় বছরের দাম্পত্যজীবন ভেঙে যায় কিশোর-রুমার। বিবাহবিচ্ছেদ হলেও, বন্ধুবিচ্ছেদ হয়নি কখনও। যোগসূত্র বোধহয় ছিলেন ছেলে অমিত কুমার। যাই হোক, সেই বছরেই মুম্বই ছাড়লেন তিনি। চলে এলেন বাংলায়। শুরু হল রুমা গুহঠাকুরতার নতুন ইনিংস। অবশ্য একটি ক্রিজে ব্যাট করেননি তিনি; অভিনয়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলত গান। আর সেইসূত্রেই জন্ম হল ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’-এর। রুমাদেবীর আরেক সন্তান। জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত বুকের কাছটিতে বয়ে নিয়ে বেড়াতেন এই কয়্যারকে। ভারতের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের ভূমিকা যে কতটা, সেটা বোধহয় কয়েকটি বাক্যে বোঝানো সম্ভব নয়। একটা সময় সলিল চৌধুরী এবং গণনাট্যের হাত ধরে যে গণসঙ্গীতের জোয়ার দেখেছিল বাংলা এবং ভারত; তারই নতুন দিগন্ত ছিল এই কয়্যার। আর শুরুর দিন থেকে রুমা গুহঠাকুরতা কাছে পেলেন আরও দুজন মানুষকে— সত্যজিৎ রায়, এবং স্বয়ং সলিল চৌধুরী। 

রুমা গুহঠাকুরতার ঠিক কোন দিকটি নিয়ে এখন আলোচনা করা যায়? কলকাতায় আসার পর তাঁর সীমা যেন আরও বেড়ে গেল। ১৯৫৯ সালে ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ দিয়ে বাংলা ছবিতে অভিনয় শুরু, শেষ হয় ‘দ্য নেমসেক’ দিয়ে (এটি অবশ্য ইংরেজি সিনেমা)। তার মাঝে অসংখ্য কালজয়ী সিনেমায় নিজেকে মেলে দিয়েছেন তিনি। কি অভিনয়ে, কি গানে। পাঠকদের মনে পড়বে ‘আশিতে আসিও না’র কথা। গাড়িতে বসে আছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুমা গুহঠাকুরতা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে উঠল ‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে’। বাংলা সিনেমার অন্যতম স্মরণীয় দৃশ্য বললে কি খুব বেশি বলা হয়! তারপর ‘গঙ্গা’, ‘অভিযান’, ‘পলাতক’, ‘বালিকা বধূ’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘গণশত্রু’… তালিকা শেষ হবার নয়। 

আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

ঘুরে ফিরে চলে আসে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের কথা। ১৯৭৫ সাল। কোপেনহাগেন ইয়ুথ ফেস্টিভালের আসরে গেছেন রুমা গুহঠাকুরতা। সঙ্গে তাঁর দল। মোট কুড়িজন ছিলেন সেখানে। মঞ্চে উঠে যখন গান শুরু করলেন সবাই, তখন সকলে মুগ্ধ। স্বাধীনতার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ, গণসঙ্গীত— সমস্ত কিছু যেন মিলিয়ে দিয়েছিল কোপেনহাগেনকে। সেবার ইয়ুথ ফেস্টিভালের মঞ্চে প্রথম পুরস্কার জিতে নেয় রুমা গুহঠাকুরতা অ্যান্ড কোং। অবশ্য খ্যাতির এখানেই শেষ নেই। ভারতের ২৫তম স্বাধীনতা দিবস, ১৯৯০-এ নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান, ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তি— সমস্ত জায়গায় উজ্জ্বল উপস্থিতি ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের। কুড়ি জনের দলটি বাড়তে বাড়তে একশো ছাড়িয়ে গিয়েছিল অচিরেই। অনুষ্ঠানে পোশাকও থাকত নির্দিষ্ট। আর সবার মাঝখানে হারমোনিয়াম নিয়ে তন্ময় হয়ে গাইছেন রুমা গুহঠাকুরতা— এই দৃশ্য একটা সময় কলকাতার মানুষ মুখস্থ করে নিয়েছিল। 

‘ও গঙ্গা বইছ কেন’, ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম’, ‘আমরা করব জয়’… কয়্যারের নাম করলে কত গানই আমাদের মনে আসবে। এসবের থেকে রুমা গুহঠাকুরতাকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায় কি! কিংবা ভি বালসারার সুরে কয়্যারের গান ‘আজ যত যুদ্ধবাজ’ গানটি? নিছক বিনোদন নয়; শিল্পও যে একটা অস্ত্র, গণজাগরণের রাস্তা, মানুষকে এক করার শপথমঞ্চ— সেটা রুমাদেবীরা না থাকলে বোধহয় বোঝা যেত না। গণনাট্যের একটা প্রভাব তো ছিলই। কিন্তু তারপরেও নিজস্ব একটা চলন ধরে রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন রুমাদেবী। আর এর মধ্যে থেকেই বেরিয়ে পড়ে তাঁর সংগঠক হিসেবে দক্ষতা। একসঙ্গে এত মানুষকে এক সূত্রে গেঁথেছিলেন তিনি। আর সেই পথ ধরেই এসেছে অভিনয়, নাচ, প্লেব্যাক। এক বছর পেরিয়ে গেল, তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু সেই আওয়াজ কি আজও ভুলতে পেরেছি আমরা? ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার তো ভুলতে দেয়নি সেসব… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘নিরন্তর গতিময়তা দিদির কাজের ক্ষেত্রকে সুদূর প্রসারিত করেছিল’, সন্দীপ রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘প্রয়াত রুমা গুহঠাকুরতা’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘Ruma Guha Thakurta and The Calcutta Youth Choir (1934-2019)’, Shoma A. Chatterji, The Citizen 

আরও পড়ুন
সরকারের প্রস্তাবে অরাজি; ’৭৫-এর জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধ কিশোর কুমার

Powered by Froala Editor

More From Author See More