পাথরের মূর্তি বদলে গেল মৃন্ময়ীতে, পেখম মেলল চালচিত্র

পুজো এসেই গেল। এই অতিমারীতেও মা আসছেন নিজের মতো করে। এদিকে পুজো হবে, আর পুজোর গল্প হবে না, তা কি হয় নাকি? দুপুরের রোদে সোনার স্পর্শ। রাতে আকাশে কিশোরী চাঁদের ফালি। কুমোরবাড়িতে চালচিত্রে ফুটে উঠছে পুরাণের আখ্যান। এই চালচিত্র হল দেবদেবীর প্রতিমার মাথার ওপরের কিংবা পেছনের সচিত্র ছাদ বা আচ্ছাদন।

এই চালচিত্রকে যতই আমাদের নিজস্ব মনে হোক না কেন, এর জন্ম কিন্তু আজ থেকে বহু বছর আগে। তাও আমাদের দেশে না। এশিয়া মাইনর বা ফ্রিজিয়াতে। মন্দিরের চালের প্রতীক হিসেবে এই অর্ধবৃত্তাকার প্রেক্ষাপট যুক্ত হত। এখনও তুর্কির ইফেসাস বা আপাসা মন্দিরে গেলে যিশুর জন্মের আগের চালচিত্র দেখা যাবে। 

সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গাপজো শুরু হলেও প্রথমেই কিন্তু চালচিত্র আসেনি। তখন মূর্তি হত পাথরের। বালথ্যাজার সলভিন্সের ১৭৭৫ নাগাদ আঁকা একটি এচিং-এ অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দুর্গাকে দেখা গেলেও সে অর্থে আমরা যাকে চালচিত্র বলি, তা নেই। পরে মাটির বাড়ির চালের আদলে দেবীর প্রেক্ষাপট বানানো হল। তাতে যোগ করা হল পুরাণের নানা কাহিনি। চিত্রিত চালের আদলে তৈরি বলে এর নাম হল চালচিত্র।

১৮০৯ সালের পাটনা ঘরানার একটি ছবিতে দুর্গাপুজো চলছে। সেখানে দুর্গার পিছনে লাল কাপড়ের চালচিত্র দেখা গেল। ১৮২০-র একটি পটেও চালচিত্র উপস্থিত এবং রীতিমতো পাকা হাতের কাজ। তার মানে বাংলায় চালচিত্র আসতে ২৫ বছরের বেশি সময় নেয়নি। 

আরও পড়ুন
কলকাতার বারোয়ারি দুর্গাপুজোয় মহিলা পুরোহিত, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ৬৬ পল্লীর

চালচিত্র শুধু মূর্তির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই উদ্ভূত হয়নি; এর চিত্রকলার একটি নিজস্ব রূপরেখা ও শৈলিগত দৃঢ় বুনিয়াদও রয়েছে। পটে বা কাগজে চালচিত্র আঁকার রেওয়াজ বহুকাল ধরে চলে আসছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাপড়ের ওপর কাগজ লাগিয়ে তার ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে প্রথমে জমি তৈরি করা হয়। কখনও কখনও আবার জমি তৈরি করতে মাটির সঙ্গে কঞ্চি এবং দরমাও ব্যবহার করা হয়। এরপর জমির ওপর খড়িমাটির সাহায্যে বা চুনকাম করে সাদা রং লাগানো হয়। সাদা রঙের ওপর নানা ছবি আঁকা হয়; যেমন শিব, শিবের অনুচর, দেবাসুরের যুদ্ধের দৃশ্য, কালীমূর্তি, রাধাকৃষ্ণ, রামচন্দ্রের অভিষেক ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
দুর্গার বিকল্প জগদ্ধাত্রী, কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই ‘পরাধীন’ বাংলায় শুরু পুজো

পুরনো চালচিত্রের সবকটি নিদর্শনের কেন্দ্র-শীর্ষে মহাদেবের চিত্র দেখা যায়। দেবীদুর্গার চালচিত্রে পুত্রকন্যা-পরিবৃত যে মহিষাসুরমর্দিনীকে দেখা যায়, তার মূলে রয়েছে বাঙালির গৃহীমন এবং যৌথ পারিবারিক চেতনা। শিব-পরিবারের এ বিন্যাসরীতিতে বাঙালি পটুয়া শিল্পীর সামাজিক অভিজ্ঞতা আরোপিত হয়েছে।

আরও পড়ুন
বিসর্জন নয় ‘পরিযায়ী দুর্গা’র, সংরক্ষণের পথে বরিশা ক্লাবের প্রতিমা

চালচিত্র অনেক সময় লোকায়ত পটের ঢঙে অঙ্কিত হলেও মহিষমর্দিনী দুর্গার সাবেকি ঢঙের মাটির প্রতিমাতে এর উপস্থিতি সহজ ও স্বাভাবিক। দুর্গামূর্তি ছাড়াও জগদ্ধাত্রী এবং বাসন্তী-দুর্গার (বসন্তকালে আরাধ্যা দেবী) মূর্তির পেছনেও চালচিত্র দেখা যায়। গুরুসদয় সংগ্রহশালা ও আশুতোষ মিউজিয়ামে রক্ষিত চালচিত্রগুলিতে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। বর্তমানে বাংলার চালচিত্র দেব-ভাস্কর্যশিল্পের বিবর্তিত লৌকিক শিল্পের এক অনবদ্য চিত্ররূপ। পরের পর্বে প্রবেশ করব দুর্গাপুজোর গল্পে।

Powered by Froala Editor