কৈলাসে ফেরার পথে উত্তরবঙ্গে থামেন দুর্গা, দশমী থেকেই শুরু নতুন পুজো

দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এল দশমীও। একটু একটু করে কমে আসছে রোশনাই। ফাঁকা মণ্ডপের আনাচে-কানাচে চাপা বিষণ্ণতা। তবে এখানে যখন ফিকে হয়ে এসেছে উৎসবের আমেজ। তখনই কিছু জায়গায় শুরু হচ্ছে পুজোর প্রস্তুতি। অন্য কোনো দেব-দেবী নয়, মা দুর্গারই পুজো। শুধু অন্য রূপে তিনি পূজিত হচ্ছেন সেখানে। ভাণ্ডানী নামে।

মূলত উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির আশেপাশের গ্রামে এই পুজো পালিত হয়। বলা যেতে পারে, একপ্রকার আঞ্চলিক উৎসব এটি, যা মূলত রাজবংশী কৃষকরাই পালন করে থাকেন। একাদশী থেকে শুরু করে চারদিন ধরে চলে এই উৎসব। সূচনা হয় দশমীর দিনই। ‘যাত্রা পুজো’-র মাধ্যমে। আসন্ন হেমন্ত ঋতুতে চাষাবাদে ফসল লাভের জন্যই কাস্তে, লাঙল, মই প্রভৃতি যন্ত্রাদির পুজোই পরিচিত ‘যাত্রা’ নামে। আর তার পরের দিন থেকেই শুরু হয় ভাণ্ডানী দেবীর বন্দনা। কিন্তু দুর্গাপূজার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত এই ভাণ্ডানী দেবী? উত্তর খুঁজতে গেলে একটু গোলকধাঁধার মধ্যেই পড়তে হবে। কারণ লোককথা নির্ভর এই পুজোর ব্যাপার এক এক জনের অভিমত এক এক রকমের। 

একটি বিশ্বাস অনুযায়ী, দশমীর রাতে কৈলাসে ফেরার পর দুর্গা আবার ফিরে আসেন মর্ত্যে। তখন স্থানীয় রাখালদের বাঘের ভয় দেখান দেবী। আর রাখালরা ভয় পেয়ে দেবীর পুজো করেন। ‘ভণ্ডামি’ করে পুজো নিয়েছিলেন বলে দেবীর নাম হয় ভান্ডানি। আবার আরেক মতে থেকে দেখতে গেলে উত্তরবঙ্গের এই গভীর অরণ্যে ভাল্লুকের উপদ্রব ছিল চিরকালই। ভাল্লুক বা ‘ভাণ্ডি’-র থেকে রক্ষা পেতেই ভাণ্ডানী দেবীর আরাধনা শুরু করেন গ্রামবাসীরা। ভাষাগত বিবর্তনের দিক থেকে দেখতে গেলে দ্বিতীয়টিই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। অরণ্যের হিংস্র প্রাণীদের থেকে বাঁচতেই এই দেবীর পুজো বলেই কি ভাণ্ডানীর অপর নাম ‘বন দুর্গা’? সঠিকভাবে বলা খুবই দুঃসাধ্য। কারণ লোকগাথায় এছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি অভিমতের অস্তিত্ব। 

কোচবিহারের রাজবাড়ির পুজো উত্তরবঙ্গে রীতিমত বিখ্যাত। দেবী যে জাগ্রত, তাও শোনা যায় মুখে মুখেই। কোচবিহারের শতাব্দীপ্রাচীন রাজবাড়ির গল্পও মিশে গেছে ভাণ্ডানীর সঙ্গে। একটি অভিমতে বলা হয় ভাণ্ডানী আসলে দেবী দুর্গার একজন ঘনিষ্ঠা পরিচারিকা। রাজবাড়ি থেকে ফেরার পথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেবীকে যে ফিরতেই হবে কৈলাসে। কাজেই উত্তরবঙ্গে কয়েকদিনের জন্য বিশ্রাম নেন সেই পরিচারিকা। পরে তিনিই পূজিত হন ভাণ্ডানী রূপে। কিন্তু কিছু মানুষের অভিমত স্বয়ং দুর্গাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন গ্রামে।     

তবে লোককথা যাই হোক না কেন, সকলেই বিশ্বাস করেন দেবী ভাণ্ডানী শসযে ভরিয়ে তোলেন ক্ষেত। অর্থাৎ প্রাচুর্যের দেবী হিসাবেই তাঁর পুজো। খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই জন্যেই হয়তো যাত্রা পুজোর ঠিক পরের দিন থেকেই সূত্রপাত হয় ভাণ্ডানীর বন্দনা। বিভিন্ন ভাষাবিদের মতেই ‘ভাণ্ডানী’ শব্দের উৎপত্তি ভাণ্ডার থেকে। এখানে যেমন অন্নপূর্ণা দেবী পার্বতীরই আরেক রূপ। তেমন ভাবেই শস্য ভাণ্ডার ভরিয়ে তোলার জন্যই রাজবংশীদের পূজ্য দেবী ছিলেন ভাণ্ডানী। পরবর্তীতে যিনি হয়ে উঠেছেন রাজবংশীদের ‘অন্নপূর্ণা’। সেইসঙ্গে দুর্গাপুজোর আমেজকে নিজেদের মতো করে ভাণ্ডানীর সঙ্গে জুড়ে নিয়েছিলেন রাজবংশীদের পূর্বপুরুষরা। ধীরে ধীরে লোকগাথায় বিবর্তন হয়েছে তার। তবে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল এই পুজো, তা জানা যায় না কোনোভাবেই। কারণ এই পুজোর কোনো লিখিত ইতিহাসই নেই।

তবে দেবী দুর্গার সঙ্গে চারিত্রিক দিকে বেশ খানিকটা বৈসাদৃশ্যই আছে বটে। শুরুতে ভাণ্ডানী দেবী ছিলেন রক্তবর্ণা। পরে তা পরিবর্তিত হয়। আদিতে ছিল দুটি হাত, পরে তাও বদলে হয় চারটি। এখানে তাঁর বাহন সিংহ নয়, বাঘ। পুজো উপলক্ষে হয় পাঁঠাবলি, ওড়ানো হয় পায়রা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ভাণ্ডানী দেবীর পুজোর কোনো মন্ত্রই নেই। অবশ্য পুরোহিত রয়েছে। যাঁরা পরিচিত ‘দেউসি’ নামে। তবে যেহেতু প্রকৃতি-বন্দনা তাই মন্ত্রের হয়টো দরকার পড়ে না। শুধু থাকে নির্মেদ আনন্দ। উৎসবের মরশুমকে আরেকটু দীর্ঘতর করে নেওয়ার প্রশান্তি। আর ভরসা তো থাকেই, শীতে খারিফ শস্যে ঝলমল করবে মাঠের পর মাঠ...

আরও পড়ুন
দুর্গার জন্য গান স্যালুট; কলকাতার ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’তে অভিনব অভ্যর্থনা দেবীর

তথ্যসূত্র - বিজয়ার পর তিস্তাপাড়ের রাজবংশীরা মাতেন অন্য শারদ উৎসবে, বিশ্বজ্যোতি ভট্টচার্য, সংবাদ প্রতিদিন

Powered by Froala Editor

More From Author See More