বিভিন্ন বাড়িতে বিসর্জনের রীতি আলাদা, বনেদি কলকাতার বিজয়া উদযাপনের ঐতিহ্য

দশমীতেই শেষ নয় উৎসব। তবে বনেদি বাড়ির পুজোগুলোয় নিয়ম করেই বিষাদ নেমে আসে দশমীর তিথি পড়লেই। শুরু হয় বিদায় জানানোর প্রস্তুতি পর্ব। তবে সব বাড়িতেই বিসর্জনের রীতি রেওয়াজ এক নয়। প্রত্যেক বাড়ির রীতিতেই লুকিয়ে আছে কিছু না কিছু অভিনবত্ব। রইল কলকাতার তেমনই ১০ বনেদি বাড়ির বিসর্জন-পর্ব...

১. লাহা বাড়ি (ঠনঠনিয়া) :

দশমীর দিনও অঞ্জলির আয়োজন হয় এই বাড়িতে। তারপর বেলপাতায় দুর্গানাম লেখেন বাড়ির পুরুষরা। মাটির প্রতিমাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনে। তবে প্রতিমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই বন্ধ হয় দরজা। ভাসান শেষে ফিরে এসে বাড়ির পুরুষরা বাইরে থেকেই ডাক দেন, ‘মা ভেতরে আছেন?’ ভেতর থেকে ইতিবাচক উত্তর দেন মহিলারা। তিনবার এই প্রশ্ন উত্তরের পালা চলার পর খোলা হয় মূল দরজা। বাড়ির মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করা সিংহবাহিনীর মূর্তি রয়েছে লাহা বাড়িতে। সেই কারণেই এই রীতি মেনে আসা হচ্ছে লাহা বাড়িতে। বিশ্বাস, সারা বছরই দেবী বিরাজমান তাঁদের মন্দিরে...

২. শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির পুজো (জোড়াসাঁকো) :

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল চিরকালই। তাই বিসর্জনের সময় ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের ঈর্ষা জাগাতে ঠাকুরবাড়ির সামনেই সাতবার ঘোরানো হত প্রতিমা। সঙ্গে বাজনা-বাদ্যি তো ছিলই। ৪০ জন বাহক দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন গঙ্গার ঘাটে। তাঁদের কড়া ভাষায় এই আদেশ দেওয়া থাকত। এখন লরিতে করেই দেবী নিরঞ্জনে যান।

আরও পড়ুন
কৈলাসে ফেরার পথে উত্তরবঙ্গে থামেন দুর্গা, দশমী থেকেই শুরু নতুন পুজো

৩. নরসিংহ চন্দ্র দাঁ বাড়ির পুজো (জোড়াসাঁকো) :

শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের সঙ্গেই রয়েছে পারিবারিক যোগ। তবে পরিবার ভাগ হয়ে যাওয়ায় পৃথক পুজোর আয়োজন হয় নরসিংহ দাঁ পরিবারে। বন্দুকের ব্যবসা থাকায় দেবীর বিদায়বেলায় গান স্যালুট দেওয়ার চল ছিল শুরু থেকেই। সেই সঙ্গে পরে যোগ হয়েছিল আমান দাগার রীতিও। কাঁধে করে প্রতিমা নিরঞ্জনে নিয়ে যাওয়ার সময় হত শোভাযাত্রা। সামনে মশাল হাতে পথ দেখাতেন লাঠিয়ালরা। পিছনে বন্দুক, তরবারি নিয়ে অজস্র প্রহরী। বাড়ির সামনেই ৭ বার ঘোরানোর পর শুরু হত সেই যাত্রা। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বিশমণি নৌকোয় মাঝগঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হত প্রতিমা। তারপর নিরঞ্জন। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় এবং ভাসানের ঠিক পরেই দুটি নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত। এখন আর আয়োজন সম্ভব হয় না এসবের। তবে শোভাযাত্রাটি হয়, গর্জায় কামানও। কিন্তু বন্ধ হয়েছে মশালের ব্যবহার।

আরও পড়ুন
দুর্গার জন্য গান স্যালুট; কলকাতার ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’তে অভিনব অভ্যর্থনা দেবীর

৪. বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো (দক্ষিণ গড়িয়া)

দেবী, তাঁর তিন সন্তান, অসুর এবং বাহনদেরও বরণ করা হয়। তবে ব্রাত্য থাকেন লক্ষ্মী। মানা হয় তিনি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মেয়ে। দেবী বিদায় নিলেও লক্ষ্মী প্রতিমা নারায়ণদেবকে নিয়ে থেকে যান বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। রয়েছে সিঁদুরখেলারও রীতি। তবে এ বাড়িতে দু’দিন হয় সিঁদুরখেলা। দশমীর পাশাপাশি অষ্টমী তিথিতেও খেলায় মাতেন বাড়ির মহিলারা। দেবীর নিরঞ্জনের পরই মাকড়চণ্ডীর পুজো দেন পরিবারের সদস্যরা।

আরও পড়ুন
নামাজ দিয়েই শুরু দুর্গার আরাধনা; আরামবাগের ঐতিহ্যবাহী পুজোয় মিশে সম্প্রীতির সুর

৫. শোভাবাজার রাজবাড়ি (শোভাবাজার) :

ব্রিটিশদের সঙ্গে সখ্য ছিল এই পরিবারের। ফলে রাজকীয় চালে কামান দেগেই বিসর্জনের পথে এগোত প্রতিমা। ৩২-৪০ জন বাহক কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতেন দেবীকে। জোড়া নৌকায় করে মাঝ গঙ্গায় গিয়ে হত বিসর্জন। ওড়ানো হত নীলকণ্ঠ পাখিও। এখন আইন হয়ে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রথার খানিক পরিবর্তন হয়েছে। বড় তরফে বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ছোট তরফ মাটির নীলকণ্ঠ পাখির মূর্তি তৈরি করে বিসর্জন দেন দেবীর সঙ্গেই।     

৬. সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো (বরিশা) :    

দশমীর দিন পান্তাভোগ হওয়ার রীতি রয়েছে এই বাড়িতে। নবমীর রাতে হওয়া রান্নাই পরদিন ভোগ হিসাবে দেবীকে দেওয়া হয়। তারপর দশমীর সকালেই বিসর্জন করা হয় ঘট। সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই শুরু হয় বিজয়ার উৎসব। দেবীপ্রতিমার সামনেই। চণ্ডীমণ্ডপে প্রণামের এই রীতি আর কোথাওই নেই সম্ভবত। একসময় টালিনালায় ভাসান হত প্রতিমার। তবে এখন গঙ্গাতেই নিরঞ্জন হয়।

৭. ধাম দত্ত বাড়ির পুজো (বিডন স্ট্রীট, হেদুয়া) :

এই বাড়ির পুজোতে দেবীকে বাড়ির মেয়ে হিসাবেই মানা হয়। কন্যাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে দিতে কে চায়? যদি আরও একটু সময় সে বাড়িতে থাকে তবে ক্ষতি কী? তাই বিসর্জনের সমস্ত আয়োজনই শুরু হয় সূর্যাস্তের পর। একসময় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ ছিল ধাম দত্ত পরিবারেও। তবে বহুদিন হল তা বন্ধ হয়েছে। জাঁকজমকও বেশ খানিকটা কমেছে এই বাড়ির।

৮. বসুমল্লিক বাড়ির বিসর্জন (পটলডাঙা) :    

সিঁদুরখেলা মানেই বিজয়া। তবে দশমী তো বটেই, বসুমল্লিক বাড়িতে পুজোর প্রত্যেকদিনই সিঁদুরখেলার আয়োজন হয়। তবে ব্যবহৃত হত দেবী চণ্ডীর মেটে সিঁদুর এবং দুর্গার লাল সিঁদুরের সংমিশ্রণ। বিসর্জনের আগে দেবীর বেনারসী খুলে নেওয়া হয়। যত্ন করে তুলে রাখা হয় তা। পরবর্তীকালে বাড়িতে নতুন বউ এলে সেই বেনারসিতেই তাঁকে সাজানো হয় বউভাতে। নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল এই বাড়িতেও। তবে ভাসান পরবর্তী আয়োজন সব থেকে অভিনব বসুমল্লিক পরিবারে। পুজোর দিনগুলিতে একেবারেই নিরামিষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হয় এখানে। তবে নিরঞ্জনের পরই খাওয়া হয় পাঁঠার মাংস। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মেটে-চচ্চড়ি। এই রেওয়াজই আর পাঁচটা বনেদি বাড়ির থেকে আলাদা করে দেয় বসুমল্লিক বাড়িকে।

৯. মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো (ভবানীপুর) :    

বিসর্জনের প্রস্তুতি শুরু হয় সকাল থেকেই। দর্পণে দেবীর মুখ দেখে প্রণাম করা হয়। তারপর প্রতিচ্ছবি দেখেই মন্ত্রোচ্চারণ করেন বাড়ির পুরুষরা। তারপর দেবী প্রতিমাকে প্রদক্ষিণ। সন্ধে গড়ালে মহিলারা দামি শাড়ি, গয়না পরে বরণ করেন দেবীকে। আজও পুরনো নিয়ম মেনেই দেবীর ভাসান হয় আদি গঙ্গায়। সেখানে কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিসর্জনের পর প্রতিমা কাঠামো থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয় কাঠামো। তা দিয়েই আবার পরের বছরের মূর্তি গড়ে ওঠে ভবানীপুরের মুখোপাধ্যায় বাড়িতে।

১০. হালদার বাড়ির পুজো (বাগবাজার) :    

বাগবাজারের হালদার বাড়িতে দশমীর দিন সিঁদুর খেলার পর রয়েছে কনকাঞ্জলির চল। আতপ চাল এবং কড়ি দিয়ে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয় মহিলাদের। তারপর বিসর্জনের দিকে এগিয়ে যায় প্রতিমা। দেবী কন্যা রূপে পূজিত হন হালদার বাড়িতে। বাড়ির মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে দশমীর দিন। মনমরা ভাব জায়গা দখল করে তাই বাড়িজুড়ে। হাঁড়ি চাপে না উনুনে। রান্না হয় না। শুধু বিজয়ার বিষাদ ঘিরে থাকে বনেদিবাড়ির অন্দরমহলে...

Powered by Froala Editor