কামানের গর্জন থেমেছে আগেই; ২৫০ বছরে কেমন আছে আন্দুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো?

বিশাল রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে সপরিবারে অধিষ্ঠিত রয়েছেন দেবী দুর্গা। বাড়ির লোকেরা সবাই ভীষণ ব্যস্ত। পুজো উপলক্ষে লোকে লোকারণ্য রাজবাড়ি; এমনকি সামনের ময়দানেও হাজির হয়েছে মানুষরা। ছোটখাটো মেলাই তৈরি হয়েছে বলা যায়। পাশেই বাঁধা আছে মহিষ আর পাঁঠা। একটু পড়েই বলির আয়োজন শুরু হবে। কামানটিকেও তৈরি করে রাখা হয়েছে। সময় হলেই গর্জে উঠবে সে। আশেপাশের বাসিন্দারাও বুঝতে পারবে, আন্দুল রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়েছে…  

সেই রাজাও নেই, রাজপাটও নেই। কিন্তু ইতিহাস আজও আঁকড়ে ধরে আছে হাওড়ার বিখ্যাত এই রাজবাড়িকে। আর রয়েছে দুর্গাপূজা। রাজত্ব গেলেও এখনও প্রথা মেনে পুজো হয়ে আসছে আন্দুল রাজবাড়িতে। সেই কামান আজ একেবারে চুপ করে গেছে, বন্ধ হয়েছে বলিও। যুগের নিয়মে চলতে চলতে রাজবাড়ির আঙিনায়ও আঁচড় পড়েছে অনেক। কিন্তু ঐতিহ্য কি এভাবে শেষ হতে পারে? দুর্গাপূজার হাত ধরেই সেই ইতিহাসকে ছোঁয়ার চেষ্টা চলে বারবার; আর তার শরিক হন আন্দুলবাসী…

শুরুটা হয়েছিল ১৭৭০ সালে। পলাশি যুদ্ধ পেরিয়ে গেছে বেশ কিছু বছর আগে। নবাবরা থাকলেও, সেই ক্ষমতা আর নেই। বরং রাজদণ্ড হাতে উঠে এসেছে ব্রিটিশরা। প্রথমে ক্লাইভ, পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের হাত ধরে বাংলা তথা গোটা ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ইংরেজ বাহিনী। এসবের ভেতরেই জন্ম আন্দুল রাজপরিবারের দুর্গাপূজার। রাজবাড়িটি ১৮৩৪-এ শুরু হলেও, ইতিহাসের শুরু আরও আগে। তখন এই বংশের কর্তা ছিলেন রামলোচন রায়। পেশায় ছিলেন লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান। পরবর্তীতে হেস্টিংসের আমলেও একই কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিজের কাজ এবং বুদ্ধির জেরেই ইংরেজ শাসকদের ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন রামলোচন। তার ‘পুরস্কার’ও পেতেন হাতেনাতে। একটু একটু করে রায় পরিবারের কোষাগারে অর্থ ঢুকতে লাগল। 

১৭৫৭ সালের পর ক্লাইভ বাংলার মসনদে বসলে চেহারাটা এক লহমায় পাল্টে যায় অনেকটা। বিপুল অর্থের মালিক হন রামলোচন রায়। আর নিজের ‘বন্ধুদের’ খালি হাতে ফেরাতেন না ক্লাইভও। যথাসময় ‘রাজা’ উপাধি পেলেন রামলোচন। শুরু হল আন্দুল রাজপরিবারের যাত্রা। এই সময়ই কলকাতায় নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারের বাড়িতে শুরু করলেন দুর্গাপূজা। সেই পুজোয় হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং ক্লাইভ। এবার রাজা রামলোচন রায়ই বা বাদ যান কেন? এত বিশাল জায়গা তাঁর, এত বড়ো জমিদারি। জাঁকজমক করে করবেন মা দুর্গার আরাধনা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বিপুল অর্থ খরচ করে ১৭৭০ সালে শুরু হল আন্দুল রাজবাড়ির দুর্গাপূজা। 

তবে সেইবারই ঘটল এক বিশেষ ঘটনা। পুজোর সময় হঠাৎই হাজির হল বেশ কয়েকটি জুড়িগাড়ি। ব্যাপার কী? রায় পরিবার সন্দিহান। হঠাৎ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন লর্ড ক্লাইভ। সঙ্গে অনেক উপঢৌকন, প্রণামী ও পুজোর সামগ্রী। তাঁর দেওয়ানের পুজো বলে কথা, তিনি আসবেন না? সমস্ত জায়গায় রটে গেল সেই খবর। সূচনালগ্ন থেকেই আন্দুল রাজবাড়ির পুজোর নাম ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। যত দিন গেল, জাঁকজমকও বেড়ে চলল সেখানে। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংসও এসেছেন এই পুজোয়। সব মিলিয়ে রাজকীয় জৌলুস আরও অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। আর তার রেশ পড়েছিল বাইরেও। রাজপরিবারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষরাও যোগ দিলেন এই পুজোয়… 

এখন সেই রায় পরিবারের রাজত্ব আর নেই। বদলে মিত্রদের বাস এখানে। কিন্তু আন্দুল রাজবাড়ি আছে সেই আগের মতোই। একটু জীর্ণ হয়ে পড়েছে বটে; কিন্তু মাহাত্ম্য কমেনি। যেমন কমেনি এখানকার দুর্গাপূজার রোশনাইও। আগের মতো জমিদারি প্রথা আর নেই, নেই মহিষ ও পাঁঠাবলি। পুজোর সময় রাজবাড়ির কামান থেকে তোপ দাগা ছিল নিয়ম। এখন কামান থাকলেও, আওয়াজ আর শোনা যায় না। এসব বাদ দিলে, নিয়ম আছে আগের মতোই। আগের মতোই চলছে কল্পারম্ভ হওয়ার রীতি। আর সেইজন্যই ১২ দিন আগে থেকেই পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে যায় আন্দুল রাজবাড়িতে। আগে রাজবাড়ির সামনের প্রশস্ত মাঠে বসত বিশাল মেলা। আর প্রতিমাও সেই সনাতনী ডাকের সাজে সজ্জিতা। এইভাবেই নতুনের মধ্যেই পুরনোকে বাঁচিয়ে রেখেছে আন্দুল রাজবাড়ি। সেই ঐতিহ্য, পরম্পরা আজও বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মরা… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More