ফর্মুলা ওয়ান ট্র্যাকে নামা একমাত্র বাঙালি, 'গতি'তেই ভালো আছেন বাবা ও ছেলে

“তখন রেসের ট্র্যাকে তো বাঙালিদের দেখাই যেত না। শুধু তখনই কেন, এখনও তো কেউই আর নেই তেমন। যাইহোক, আমিই প্রথম বাঙালি হিসেবে নামলাম মোটর স্পোর্টসে। ভারতেও সেই প্রথম ফর্মুলা ওয়ান রেস অনুষ্ঠিত হল দিল্লিতে। তবে বাংলা থেকে নয়, আমি নাম দিয়েছিলাম চণ্ডীগড় থেকে।”

বলতে বলতে চকচক করে উঠছিল দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়ের চোখ। অবশ্য জন মুখোপাধ্যায় নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাকে আরও একটা ক্রীড়া দুনিয়ার অংশীদার করে তুলেছেন তিনি। তাও একেবারে ফর্মুলা ওয়ানের মার্শাল হিসেবে। মোটর স্পোর্টসের জগতে সবচেয়ে উঁচু দরের রেস ফর্মুলা ওয়ান। যে খেলার পদে পদে ভয়। যে কোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে অঘটন।

তাঁর বর্ণনা শুনতে শুনতে সহজেই কল্পনা করা যায় সেই দৃশ্য। সুবিশাল ট্র্যাক ধরে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলেছে একের পর এক ফর্মুলা ওয়ান গাড়ি। প্রতিযোগিতার মধ্যেও সতর্কতায় কমতি নেই। একচুল এদিক-ওদিক হলেই বিপদ। গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে দর্শকদের চিৎকার। গতির এই খেলায় বাজিমাত করবে কে? ভাবছে সকলেই। ভাবছেন দেবদত্তবাবুও। দৌড় দৌড় আর দৌড়ের এই খেলায় কোনো অঘটন ঘটবে না তো?

কথায় আর কল্পনায় কেটে গেল অনেকটা সময়। অতীতচারণার মধ্যেই দেবদত্তবাবু জানালেন, আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে কলকাতা জোবা রেসিং বা কেজেআর। এক বঙ্গসন্তানের উদ্যোগেই প্রতিযোগিতায় নামবে ফর্মুলা কার। অবশ্য অনুষ্ঠানটি কলকাতায় হলেও তাতে যাঁরা অংশ নেবেন, তাঁরা কেউই বাঙালি নন। ভারতের নানা প্রান্তের প্রতিযোগীরা আসবেন সেই আত্মপ্রকাশের মঞ্চে। কিন্তু বাঙালিরা থাকবে না কেন? উত্তরে দেবদত্তবাবুর গলায় যেন আক্ষেপের সুর শোনা যায়। “বাঙালিদের দিয়ে কার রেসিং হবে না।” এরপরেই বলেন, “হবে কী করে? কেউ পরিকাঠামো তৈরির দিকে নজর দিয়েছে নাকি?” তবু নতুন কিছু একটা করার ইচ্ছে নিয়েই এগিয়ে চলেছেন দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়।

জানালেন, এই খেলার সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ছেলে তথাগতর কাছেই। ছোটো থেকেই গাড়ির প্রতি আকর্ষণ তথাগত, ওরফে তুন্নার। মাত্র ৬ বছর বয়সে কলকাতার বুকে মোটর ড্রাইভিং-এ হাতেখড়ি তাঁর। ওই বয়সেই সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্ককেও গাড়ি চালিয়েছেন তুন্না। আর কিছুটা বড়ো হতেই ইচ্ছে হল ফর্মুলা কার চালানোর। ছেলার ইচ্ছেতে বাধা দেননি দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়। বরং নিজের মতো করে জানতে চাইলেন এই অচর্চিত বিষয়টি নিয়ে। ফর্মুলা ওয়ানের উপর একাধিক বই পড়তে শুরু করলেন। আর তার পরেই নতুন এই খেলার প্রতি টান অনুভব করলেন তিনিও।

আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?

ফর্মুলা কার নিয়ে ১৩ বছর বয়সে ট্র্যাকে নামলেন তুন্না। ভারতের ইতিহাসে এখনও অব্দি তিনিই সর্বকনিষ্ঠ ফর্মুলা কার চালকের রেকর্ড ধরে রেখেছেন। বাঙালিদের মধ্যে তো আর কেউ এই খেলায় এগিয়েই এল না। জন মুখোপাধ্যায়ের শুরু ইন্দো-ভুটান ফ্রেন্ডশিপ র্যা লি থেকে। তখন তাঁর বয়স ৫০। এই বয়সে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখা এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টা করা, সত্যিই অবাক করে বৈকি। তাও আবার একেবারেই ফর্মুলা ওয়ানের মার্শাল! তিনি নিজে ড্রাইভিং সিটে বসেন না। কিন্তু গোটা খেলায় গাড়ির এবং তার চালকের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব থাকে মার্শালদের উপরেই। কেই মেডিক্যাল মার্শাল, কেউ ফায়ার মার্শাল। জন মুখোপাধ্যায় একজন রিকভারি মার্শাল। ট্র্যাকে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সেই ট্র্যাক ক্লিয়ার করতে হয় তাঁকে। কাজে দ্রুততা প্রয়োজন বললে কম বলা হয়, প্রয়োজন এক অসম্ভব ক্ষিপ্রতার। আর সেই সঙ্গে নানা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো আছেই।

“খেলা বলতেই তো বাঙালি শুধু ফুটবল আর ক্রিকেটের কথাই বলে। আমরা চাই পাশাপাশি মোটর স্পোর্টসও সম্মান পাক।” বলছিলেন তথাগত মুখোপাধ্যায়। অথচ বাবা বা ছেলে কেউই এখনও নতুন প্রজন্মের মধ্যে কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না। তথাগত অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি শুধু কিছুদিন বিরতি নিয়েছেন। রেসের ট্র্যাক থেকে বিদায় নেননি। কলকাতার বুকে এমন একটা খেলার আয়োজন করতে পেরে দুজনেই খুশি ধরে রাখতে পারছেন না। অবশ্য প্রতিক্রিয়া আসছে মিশ্র ধরণের। “গাড়ি সম্বন্ধে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা যথেষ্ট আগ্রহী”, বলছিলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা

তাহলে কি এই ‘কলকাতা জোবা রেসিং’ ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনাকে সামনে এনে হাজির করবে? তথাগত বলেন, “কেউ এগিয়ে এলে তাকে আমি সবরকমভাবে উৎসাহ দেওয়ার ও পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।” হয়তো খুব শিগগিরি নয়, কিন্তু খুব দূরেও নিশ্চই নয়; যেদিন দেবদত্ত মুখোপাধ্যায় অ্যান্ড সনের মতো বাংলার ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা শচিন-সৌরভ বা মেসি-রোনাল্ডো হওয়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখবে লুইস হ্যামিলটন বা আইরটন সেনা হওয়ার। রেসিং ট্র্যাকে দাপিয়ে বেড়াবে বাঙালিরাও। আর দেবদত্তবাবুদের এই স্বপ্নের সঙ্গে যদি কলকাতাও জড়িয়ে থাকে, এর চেয়ে আনন্দের কিছু হয়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More