ছবি আঁকলে সহজ হবে শিকার, ভাবত ভীমবেটকার শিল্পীরা

প্রথম পর্ব

গুহাচিত্র। শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধকার একটা গুহায় অপটু বা পটু হাতে দেওয়ালের পর দেওয়াল জুড়ে নানান ছবি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, মানুষ যখন আধুনিক রং বানাতে শেখেনি, আধুনিক শিল্পের নামগন্ধ না-জানা সেই মানুষরাই কিভাবে তাদের জীবনচর্যার ছবি এঁকে গেছে দেওয়ালের পর দেওয়াল জুড়ে। ছবি মানেই কল্পনা, ছবি মানেই মানুষের ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ রঙের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গুহাচিত্রগুলির মূল বিষয়বস্তু শিকার, বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং সেসময়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের প্রধান জীবিকাই ছিল শিকার। এই শিকারের চিত্রই দেখা যায় বেশিরভাগ ছবিতে। কোনো ছবিতে আছে অস্ত্র-বিদ্ধ পশু, কোনো ছবিতে আছে আহত পশু, কোনোটিতে আবার আছে পশুর পাল। মানুষকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে আছে ঘোড়াসওয়ারের ছবি, নৃত্য, বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের ছবি ইত্যাদি। ঐতিহাসিকদের মতে শিকারের ছবিগুলো আঁকা হত শিকারের পশুকে আয়ত্তে আনার জন্য। তখনকার মানুষের মাঝে বাস্তব ও অলৌকিকতার ভেদ হয়তো ছিল না। তারা ভাবত, পশু শিকারের ছবি আঁকলে ছবির সম্মোহনী ক্ষমতায় শিকার সহজ হবে। অর্থাৎ, তাদের কল্পনায় জয় করার যে ইচ্ছা সেটাই ফুটে উঠত শিকারের এই ছবিগুলোতে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়বস্তুর ছবিগুলো ধর্মীয় বা সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার জন্য আঁকা বলেই ধারণা করা হয়।

দ্বিতীয় পর্ব
এই গুহাগুলির সামনেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাভারতের ভীম

প্রাচীন চিত্রশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন গুহাচিত্র। প্রাচীন তো বলছি, কিন্তু তা কত প্রাচীন? বলছি সেই সময়ের কথা যখন মানুষ বাস করত গুহায়, খাদ্যের জন্য নির্ভর করত পশু শিকারের উপর। তখন মানুষ যে শুধু শিকার করে, বনে জঙ্গলে ঘুরেই জীবন কাটাত তা নয়। তাদের তৎকালীন ধ্যান-ধারণা, জীবন যাপনের ছবি এঁকে রাখত গুহার দেয়ালে। এসব চিত্রই গুহাচিত্র বা কেভ পেইন্টিং নামে আমাদের  কাছে পরিচিত। এ পর্যন্ত সভ্য মানুষের আবিষ্কার করা গুহাচিত্রগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার মারকো দ্বীপের গুহাচিত্রকেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। যার আনুমানিক বয়স প্রায় পঁয়তিরিশ হাজার বছর। গুহাচিত্র আঁকতে সে সময়ের শিল্পীরা প্রাকৃতিক উপাদানই ব্যবহার করত। রঙ হিসেবে রঙিন মাটি, কয়লা ও বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে গাছের ছালও। গুহার দেয়াল সমান করার জন্য পাথর দিয়ে ঘষা হয়েছে।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

প্রথম যখন আমার এই প্রাচীন গুহাচিত্রের সঙ্গে সম্যক আলাপ হয় তখন তা বোঝার মত যথেষ্ট বয়েস আমার ছিল না। একেবারে ছেলেবেলার ইতিহাস বইতে কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল অবশ্য, কিন্তু তা দিয়ে একটা সামান্য পরিচিতি হয়, ধারণা হয় না। এমনিতেই ছবি সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। কিন্তু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর একটা পোকা সেই ছেলেবেলা থেকেই মাথার ভেতর কামড়ে চলত আমাকে। বাড়িতে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়া হয়ে যেত আমার। অর্থাৎ সোজা বাংলায় যাকে বলে পালানো। এর এই পালানোর হাত ধরেই আমার ভীমবেটকার সঙ্গে আলাপ।

মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের ৪৫ কিমি উত্তর পূর্বে ও হোসাঙ্গাবাদের ৩০ কিমি উত্তর পশ্চিমে, ওবাইদুলাগঞ্জ-ইটার্সি হাইওয়ের ধারে ভীমবেটকার বিশাল জঙ্গল। দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপকণ্ঠে, বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমানার গা ঘেঁষে, মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার রাতাপানি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির মধ্যে, একটি রুক্ষ এবং নীচু পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ভীমবেটকার ব্যাপ্তি। ভীমবেটকার পর্ণমোচী (ডেসিডুয়াস) জঙ্গলমহল পাহাড় প্রকৃতির রুক্ষতাকে ঢেকে দিয়েছে অনেকটাই। ভীমবেটকার গা ঘেঁষে ভিয়ানপুর গ্রাম। ভীমবেটকার পাহাড়গুলি সমুদ্র লেভেলের ৬০০ মিটার উঁচুতে। এই জঙ্গলের বনমোরগ, কোয়েল, হুপো, শালিখ আর মাছরাঙারা দলে দলে এসে আশ্রয় নেয় ভীমবেটকার গুহার মধ্যে। পাইথন, কোবরা ও আপনমনে ঘুরে বেড়ায়। এছাড়াও আছে শ্লথ বেয়ার, হায়না, নীলগাই, চিতল হরিণ আর শজারু। গ্রামের মানুষ আর পশুপাখির জন্য আছে বেতোয়া আর নর্মদা নদীর জল। মিডিয়াম আকৃতির স্যান্ড স্টোনের এই পাহাড়গুলির রঙে অনেকটাই অর্থকোয়ার্জাইট পাথরে রূপান্তরিত হওয়ায় দুধ সাদা রঙে হালকা গোলাপি ছোঁয়া এসেছে । ভীমবেটকার ঘন জঙ্গল সংলগ্ন উপত্যকায় ঘন জঙ্গলে বসন্তে পলাশের আগুন জ্বলে। মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল হয় জংলি ভাল্লুক। এত প্রত্যন্ত পরিবেশে পশুপাখি, ডেসিডুয়াস বৃক্ষরাজি আর পাহাড়মাটির এই একাত্ম ইকোসিস্টেম ভীমবেটকার পরিবেশকে একটা অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে। প্রকৃতির খেয়ালে পাহাড় কথা বলে ওঠে এখানে। একেকটি পাহাড়ের আকৃতি একেকরকম। সয়েল ইরোশানের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এগুলি। প্রাক ঐতিহাসিক যুগে যখন মানুষের উৎপত্তি হয়নি, তখন এই পাহাড় ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি। আর সেই সময়ই জলের খরস্রোতে তৈরি হয়েছিল গুহাগুলি। কালের বিবর্তনে যখন সেই পাহাড় সমুদ্র থেকে উঠে এসে স্থলভাগের মাঝে পৌঁছে যায়, তখন আদিম মানুষ সেই গুহা আবিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করে। সেই সমস্ত মানুষ মনের খেয়ালে অবসর যাপনের খেলায় আপনমনে মেলে ধরে তাদের সৃজনশীলতা; যার ফলস্বরূপ আজও আমরা দেখতে পাই এই গুহাচিত্রগুলি।

(ক্রমশ)

More From Author See More