সুনীলকে যৌনমিলনের প্রস্তাব দিলেন গিন্সবার্গ, পালটা শর্ত সুনীলেরও

সুদূর আমেরিকায় এক সন্ধ্যাবেলা। অ্যালেন গিন্সবার্গের পাশে শুয়ে আছেন তরুণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাৎই অ্যালেন ডেকে উঠলেন সুনীলকে। দিলেন যৌন মিলনের প্রস্তাব। শুনে চমকে উঠেছিলেন সুনীল। ঠিক কী বলেছিলেন অ্যালেন?

অবশ্য সে-কথা বলার আগে যেতে হবে গল্পের একেবারে শুরুতে। সেটা ষাটের দশকের আমেরিকা। নিউ ইয়র্ক শহরের পাশেই ম্যানহাটন দ্বীপ, তারও এক প্রান্তে গ্রিনিচ ভিলেজ। আমেরিকার সবচেয়ে অপরাধপ্রবন জায়গা হিসাবে চিহ্নিত ছিল এই এলাকা। বিশেষ করে গাঁজা-হেরোইন এমনকি এল.এস.ডি.-র নেশায় আচ্ছন্ন তরুণ প্রজন্ম। প্রথম আমেরিকা গিয়ে এই এলাকাতেই পৌঁছলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কারণ, বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বাস সেখানে। সুনীল আমেরিকার কাউকেই চিনতেন না। একমাত্র গিন্সবার্গকে তিনি চিনতেন। কয়েক বছর আগেই যে তিনি কলকাতা এসেছিলেন। কফিহাউসে বসে কত আড্ডাই না দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। অবশ্য গিন্সবার্গেরও তখন কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি বলেছিলেন গ্রিনিচ ভিলেজের এক বইয়ের দোকানে খোঁজ করলেই তাঁর সন্ধান পাওয়া যাবে।

হোটেলে মালপত্র রেখে গিন্সবার্গের খোঁজে বেরোলেন সুনীল। পরিচয় দিতেই বইয়ের দোকানদার তাঁকে ওপরে যেতে বললেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই কানে এল বাংলা গান। একটি ঘর থেকে ভেসে আসছে আব্বাসউদ্দিনের ‘ফান্দেতে পড়িয়া বগা কান্দে রে।’ সুদূর আমেরিকায় বসে যে মানুষটি আব্বাসউদ্দিনের গান শুনছেন, তিনি অ্যালেন গিন্সবার্গ। ঘরের দরজা ঠেলতেই দেখলেন এক মিলিটারি পোশাক পরে কবি রান্নায় বসেছেন। ভাত-ডাল রান্নাটা তিনি বেশ ভালোই শিখে গিয়েছেন, জানিয়েছিলেন সুনীলকে। কিন্তু সুনীল অবাক হয়েছিলেন তাঁর মিলিটারি পোশাক দেখে। আজীবন যুদ্ধের বিরোধিতা করে যে মানুষটি মার্কিন সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন, তাঁর পরনে মিলিটারি পোশাক? হাসতে হাসতে গিন্সবার্গ উত্তর দিয়েছিলেন, এক মিলিটারি বন্ধু যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁরই সব পোশাক গিন্সবার্গকে দান করেছেন বন্ধুর স্ত্রী। হোক না মিলিটারির, তবু তো পোশাক।

চিরকাল জীবনকে এভাবেই দেখেছেন গিন্সবার্গ। তাঁর কাছে ব্যক্তিগত বলে কিছুই ছিল না। বিট আন্দোলনের প্রবক্তা এই মানুষটি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যিকরা সাহিত্যচর্চা ছাড়া কিছুই করবে না। এমনকি তাঁদের ভরণপোষণের জন্য কোনো সরকারি অনুদানও থাকবে না। তাঁরা সাহিত্যের প্রয়োজনে মানুষের কাছে পৌঁছবেন। মানুষের কাছ থেকে যা পাবেন, তাই তাঁদের সম্বল। গিন্সবার্গের কলকাতা ভ্রমণের সময় এই বোহেমিয়ান চরিত্রটাই আকর্ষণ করেছিল সুনীল-শক্তির মতো তরুণ কবিদের। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেই অবশ্য তাঁর ভাব জমেছিল বেশি। তাই পাশাপাশি খেতে বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বারবার বলছিলেন, ‘আই মিস শাকটি।’ এইসব ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যেই দরজা ঠেলে ঢুকলেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ। গিন্সবার্গ আলাপ করিয়ে দিলেন, তাঁর স্ত্রী পিটার অলভস্কি। গিন্সবার্গের স্ত্রী একজন পুরুষ? যদিও সুনীল আগেই জানতেন তিনি ঘোষিত সমকামী। এই নিয়ে সেই সময়ের আমেরিকাতেও কম জলঘোলা হয়নি।

আরও পড়ুন
গিন্সবার্গের কবিতা ছাপিয়ে খেটেছেন জেলও; প্রয়াত মার্কিন কবি ও প্রকাশক লরেন্স ফারলিংহেটি

খামখেয়ালি, বাউন্ডুলে গিন্সবার্গ। অন্যদিকে পিটারের মধ্যে সুনীল দেখেছিলেন সবকিছু গুছিয়ে রাখার এক অদ্ভুত দক্ষতা। দেখতে দেখতে তিনজনের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠল। পরেরদিনই তাই হোটেল থেকে বাক্স-প্যাঁটরা গুটিয়ে সুনীলকে উঠতে হল পিটার-গিন্সবার্গের নতুন বাড়িতে। হ্যাঁ, এতদিনের ঠিকানাহীন অ্যালেন গিন্সবার্গ ততদিনে একটা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন। নেবেন না কেন? তাঁর বইয়ের কাটতি তো নেহাৎ কম নয়। কিন্তু সেই রয়্যালটির টাকাতেও কি একাই সুখে থাকবেন গিন্সবার্গ? কখনই না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় সেই বাড়ির কিম্ভুত চেহারা। প্রায় ৪টি ঘরের সমান প্রশস্ত একটিমাত্র ঘর। তার মধ্যেই একদিকে রান্নার জায়গা, মাঝখানে বসার জায়গা, আবার একদিকে বিছানা। সারাদিন সেখানে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। মানুষ বলতে নানা কবি-শিল্পী। কেউ একেবারেই ব্যর্থ, কেউ খানিকটা নাম করতে পেরেছেন। একটি ঘরের মধ্যেই চলছে গান-বাজনা, কবিতাপাঠ। তার মধ্যেই নেশায় ডুব দিচ্ছেন কেউ। নেশার মধ্যে জড়িয়ে ধরছেন প্রেমিক-প্রেমিকাকে। তখন একদিকের আলো নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক অবাধ মুক্ত জীবন। যৌনতাও অবাধ। মধ্যবিত্ত বাঙালি সুনীলের চোখে সেই ঘর হয়ে উঠেছিল এক পরম বিস্ময়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে অবশ্য সেখানে নেশা করেননি। এর আগে কলকাতায় তারাপদ রায়ের বাড়িতে গিন্সবার্গ এল.এস.ডি. সেবন করিয়েছিলেন সুনীল-শক্তিকে। দুজনে নেশার মধ্যে ফিরে গিয়েছিলেন শৈশবের নির্মল স্মৃতিতে। কিন্তু সেই একবারই। এমনকি গিন্সবার্গের ক্রমাগত প্রশ্রয়ের পরেও মুক্ত যৌনাচরণের স্রোতে ভেসে যাননি সুনীল। কিন্তু এমনই এক রাতে হঠাৎ ঘুমন্ত সুনীলকে জাগিয়ে তুললেন গিন্সবার্গ। বললেন, “সুনীল, হবে নাকি?” তাঁকে যৌনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন নাকি গিন্সবার্গ? সুনীল রোমাঞ্চিত। এর আগে কোনো পুরুষকে সঙ্গী হিসাবে বেছে নেননি তিনি। তিনি উত্তর দিলেন, “ঠিক আছে, হোক। তুমি একবার, তারপর আমি একবার।” এবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন গিন্সবার্গ। “না না, তা হবে না। আমি অ্যাক্টিভ। আমি প্যাসিভ হতে পারি না।” সুনীলও গোঁ ধরে বসে রইলেন। তিনি এই নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পুরোপুরি নিতে চান। ফলে এরপর আর কথা এগোয়নি। দুজন দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালে উঠে আর যেন কারোরই মনে নেই গত রাতের কথা।

আরও পড়ুন
কমলকুমারের কাছে ফরাসি শেখার ‘অত্যাচার’, দু’মাসেই হাল ছাড়লেন সুনীল

গিন্সবার্গ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বারবার অনুরোধ করেছিলেন আমেরিকায় থেকে যাওয়ার জন্য। বলেছিলেন তাঁর কবিতা অনুবাদের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। কিন্তু সুনীল থেকে যাননি। এর বেশ কয়েক বছর পর আবার দুজনের দেখা কলকাতা শহরেই। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের উপর পাকিস্তানি খানসেনাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করে রাস্তায় নামলেন গিন্সবার্গ। সঙ্গী আবারও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এমনই এক দিনে যশোর রোডের রাস্তায় বসে লিখলেন সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’ মানচিত্রের কাঁটাতার পেরিয়ে কখন যে সেই মানুষটা আপন করে নিয়েছিলেন এই বাংলাকেই। আসলে শিল্পের কি কোনো দেশ থাকে? শিল্পীরাও তাই দেশের সীমানার বাইরে।

তথ্যসূত্রঃ ছবির দেশে কবিতার দেশে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আরও পড়ুন
‘কলকাতা শহরটা আমার, ফিরে গিয়ে ওখানে রাজত্ব করব’ – বিদেশ থেকে চিঠি এল সুনীলের

Powered by Froala Editor

More From Author See More