‘কলকাতা শহরটা আমার, ফিরে গিয়ে ওখানে রাজত্ব করব’ – বিদেশ থেকে চিঠি এল সুনীলের

ফরিদপুরের মাদারিপুর মহকুমা শহরের একটি সাধারণ গ্রাম মাইজপাড়া। সেখানেই একটি ছোট্ট মাথা গোঁজার মতো আশ্রয়ে বেড়ে উঠছিল এক শিশু। কখনও পুকুরে সাঁতার কেটে, কখনও মাছ ধরে, আবার কখনও গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে ‘জম্বুরা’ বা বড়ো বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলেই কাটছিল। সেসব বহু আগের কথা। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এলেও, বাংলার অমন নিরালা শান্ত ছোটো গ্রামের ভেতরে সেরকম কিছুই মনে হয়নি। আস্তে আস্তে ছেলেটি কলকাতার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে এসে পড়ল। তখনও কি জানত, এই ঘূর্ণাবর্ত আরও কী কী নিয়ে বসে আছে? যে গ্রাম্য ছেলেটির কাছে কলকাতা ছিল এক গোলকধাঁধা, সে-ই কিনা একদিন মধ্যরাতে শহর শাসন করবে! ছড়ি নয়, বন্দুক নয়; শাসন করবে শব্দের জোরে, কবিতার হাত ধরে। তিলোত্তমা জানবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা, তাঁর সৃষ্টির কথা…

কোথায় না যাতায়াত তাঁর! যৌবনে কবিতার হাত ধরে যার যাতায়াত শুরু; পরে দেখলেন গল্প লিখলে একটু বেশি টাকা পাওয়া যায়। নিজের বইপত্তর কেনা আছে, সংসারের অবস্থাও তো সেরকম নয়। সেই আশাতে গল্প লেখাও শুরু। ধীরে ধীরে পরিধিটা বাড়তে লাগল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার হাত ধরে পঞ্চাশ-ষাটের বাংলা সমাজের একটা রূপ পাওয়া যায়। সেখানে উঠে আসে সিদ্ধার্থদের মতো প্রতিবাদী যুবকেরা, যাঁদের দু’চোখে জ্বলছে আগুন। উঠে আসে একটা রোমান্টিকতা। শুধু প্রেম নয়, একটা লড়াই। বদল আনার লড়াই, তরুণদের পায়ের নিচে জমি পাওয়ার লড়াই। নীরাকে খুঁজে চলার অভ্যাস। কখনও নিখিলেশ, কখনও নীললোহিতের আড়ালে থেকে সেসব দেখে চলেছেন সুনীল। আর সেই অনন্ত সাহিত্যের বুকে ডুব লাগিয়েছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম… 

কবিতা, গল্প, উপন্যাস— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই দিকগুলো সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলার নেই। কিন্তু অন্য রাস্তাগুলো? মনে পড়ে খালাসিটোলার সেই উত্তাল আসরগুলো। সুনীল, শক্তি এবং আরও বেশ কয়েকজন তরুণ; আর তাঁদের মাঝে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কমলকুমার মজুমদার। ততদিনে সিগনেট প্রেস থেকে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে ‘’কৃত্তিবাস’-এর। কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্ত পরামর্শ দিলেন একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান খোলার, অনেকটা ক্লাবের মতোই। শুরু হল ‘হরবোলা’র যাত্রা। কত জনই না এসেছেন এখানে। সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সন্তোষ রায়ের মতো মানুষরা প্রথম দিন থেকে যুক্ত ছিলেন। সেখানেই ঠিক হল, নাটক আয়োজিত করা হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটবেলায় নাটক করেছিলেন বটে; কিন্তু সে অভিজ্ঞতা খুব যে সুখকর ছিল বলা যায় না। সিটি কলেজে পড়ার সময় একটি নাটকে সহ-অভিনেতা ছিলেন সুনীলেরই এক বছরের জুনিয়র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘হরবোলা’র নাটক কিন্তু যেমন তেমন করে নয়, রীতিমতো কোমরে গামছা বেঁধে প্রস্তুতি শুরু হল। উল্টোদিকের নির্দেশকের নাম যে কমলকুমার মজুমদার! সমস্ত কিছু নিখুঁত হওয়া চাই তাঁর।

‘হরবোলা’র প্রথম নাটকটি ছিল ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। তাতে জাম্বুবানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়! দ্বিতীয় নাটকটি যাকে বলে গ্র্যান্ড প্রোজেক্ট- রবি ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’। আগের নাটকের জাম্বুবান এবার যন্ত্ররাজ বিভূতি’র চরিত্রে। এইভাবেই এগোচ্ছিল সুনীলের অভিনয় জীবন। পরবর্তীকালে বয়সকালেও মঞ্চে এসেছেন। তাঁর উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হয়েছে, নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি নিজেও মৌলিক নাটক লিখেছিলেন। সব মিলিয়ে এখানেও তিনি সব্যসাচী! 

ষাটের দশকে কলকাতায় দানা বাঁধছিল হাংরি আন্দোলন। মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাক প্রমুখরা বাংলার সাহিত্য জগতকে কাঁপিয়ে রেখে দিয়েছিল। যেমন উত্তাল হয়েছিল নকশাল আন্দোলন, তেমনই এঁরাও প্রতিষ্ঠানকে সবসময় আক্রমণ করতেন। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর এই আবহে সুনীল ছিলেন আমেরিকায়, আয়ওয়াতে। সেখান থেকেই মলয় রায়চৌধুরীকে লিখলেন চিঠি। পরিষ্কার বক্তব্য তাঁর, “তবে একথা ঠিক, কলকাতা শহরটা আমার। ফিরে গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। তোমরা তার এক 'চুলও' বদলাতে পারবে না।” এক ঝলকে বেরিয়ে এসেছিল রাতের বুকে কলকাতা শাসন করার সেই চেহারাটা। অনেকে বিরোধিতাও করেছিলেন এমন বক্তব্যের। কিন্তু বাঙাল ছেলেটার এমন দামাল ভঙ্গি চিনিয়েছিল অধিকারের কথা। যে দামাল ভঙ্গিতে পাহাড়ে, রাস্তায়, রাতের গভীরে গিয়ে গেয়ে উঠেছেন গান। নিজেই বলেছিলেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর লোকগীতির প্রতি বেশি টান। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি তো সবসময়ই সেখানে বিরাজ করছেন। সবকিছুই কালের যাত্রাপথে চলতে চলতে কখন হয়ে গেছে টের পাননি নিজেও। প্রেমিকার বাড়িতে ‘দেশ’ পত্রিকা দেখে সেখানে কবিতা পাঠানো; তারপর বহু বছর আরও কত লেখা সেখানে প্রকাশ পাবে। ভেবেছিলেন এতকিছু? এভাবে এতকিছুর মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা তো রবি ঠাকুরই শিখিয়ে গেছেন আমাদের। যতদিন শ্বাস, ততদিন আশ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই তারুণ্যেই ভরসা রেখে গিয়েছেন তিনি...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘ঢের হয়েছে’, মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন

More From Author See More