‘ঘর নেই জমি নেই পেটে নেই ভাত’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় ফুটে ওঠে আজকের পরিস্থিতিই

সাহিত্যের এক অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখনও কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনেছ?’ তিনি তো বিস্ময়ে হাঁ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কোনো কবি থাকতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করেন না, বরং তিনি বিশ্বাস করেন ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের লেখককে। তিনি আস্থা রাখেন ‘হারানের নাতজামাই’, ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’, ‘সরীসৃপ’ গল্পের জাদুকরের উপর।

এবার তাঁর হাতে আমি একটা পুরানো বই তুলে দিলাম, বইটির নাম ‘ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’। বইটির সম্পাদনা করেছেন কবি যুগান্তর চক্রবর্তী। বইটি পেয়ে তাঁর মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না, তিনি অবাক হয়ে বইটির পাতার পর পাতা পড়তে লাগলেন গোগ্রাসে। এক নিঃশ্বাসে বইটি শেষ করে তিনি বারবার দুঃখ করছিলেন কেন তিনি এতদিন এমন সম্পদকে হাতে পাননি! তবে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে উল্লেখ করলাম দিবারাত্রির কাব্যের কথা, যে বইটি তো একটি উপন্যাস নয়, একটি দীর্ঘ কবিতা। তরুণ বয়সের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভেতরে কতটা কবিত্বশক্তি সজাগ থাকলে ওই উপন্যাসটি লেখা যায়, সেটাই স্মরণ করিয়ে দিলাম তাঁকে।

১৯৫৩ সাল। ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বৃদ্ধির প্রতিবাদে উত্তেজিত জনতা প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, তার জন্য স্বাধীনতা পত্রিকায় কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শাসকের প্রতি ক্ষুরধার ব্যঙ্গে কলম ডুবিয়ে লিখলেন ‘ছড়া’ কবিতাটি - ‘ আমরা শুনেছি তার/ পুলিসি ঝঙ্কার,/ অনেক অনেক বার -/ সাদা রাজা কালো দাস/ মিলে যিনি অবতার/ স্বাধীনতা-হীনতার।/ বার বার ফোস্কায়/ কড়া পড়ে সেরে যায়,/ লাঠি ও গুলির ঘায়/ জনতার প্রাণটায়/ মোটে আর ব্যথা নেই/ ভীরুতার ফোস্কায়/ কড়া পড়া একতায়’।

অনাহারে মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটি মূর্তিমান বিভীষিকা, সেখানে রেশন দোকানে নিম্নমানের চাল দিচ্ছে, সেই চালের জন্য গরীব মানুষের দীর্ঘ লাইন পড়েছে, কবি সেই চিত্র দেখে নিপুণ ব্যঙ্গবাণ ছুঁড়ে দিচ্ছেন মানুষের বাঁচা-মরা নিয়ে- ‘বাপটা মরল, ভাইটাও/ বোনটা ভগবান পেয়েছে টাকা-ওলা গান্ধী ভাঙানো ব্যবসায়।/ ছেলেটা মরেছে, মরেছে!/ শুকনো মাঠ বলে ছেলে বুঝি মরেছে?/ সত্যি, সাধারণ মানুষের জীবনে এর চেয়ে সুন্দর / আর কি থাকতে পারে?’

তবে তিনি ইচ্ছা করে রাজনীতির নীতিকথাকে তাঁর কবিতাতে প্রবেশ করাননি, বরং মানুষের দুঃখ কষ্ট দুর্দশা তাঁকে কলম তুলে নিতে বাধ্য করেছিল, যেখানে মানুষ শাসক দলের দরজায় দরজায় ঘুরে তাদের পদসেবা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করত, সেখানে তিনি কংগ্রেসি শাসনের প্রতি কটাক্ষ করেছেন ‘গুড়ের ভাঁড়’ কবিতাতে – ‘ ভিক্ষে করা গুড়ের ভাঁড়ে পিঁপড়ে অগণন / রইল মধু হুল উঁচানো মৌমাছিদের চাকে,/ স্বাধীনতার জীবন সুধারস, / শূন্য গুড়ের ভাঁড়েই লোভী পিঁপড়ে হল খুশি।/ সবার কাছে সস্তা যেন / ভাঁড় চেটেই জীবনটাকে মিষ্টি করার সাধ।’ মানুষ্যধর্মের গান গাওয়া কবি মানবতার ধর্মকে ভূলুণ্ঠিত দেখলে গর্জে উঠছেন বার বার, তাঁর কাছে মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং তিনি তার পূজারি।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে চায়ের কোম্পানিগুলো বিদেশি মালিকানার হাতে চলে গিয়েছিল তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন – ‘লন্ডনকে ঘুষ দিয়ে আমরা চা পান করি’, আমাদের সম্পদ বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছ অথচ দেশের মানুষ দু মুঠো খাবার জোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এদিকে সরকারও পরোক্ষভাবে দেশের উৎপাদনে বেনিয়াদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। দেশে দু হাতে লুঠে দিচ্ছে নিচ্ছে বেনিয়ারা। বুড়ো সন্ত্রাসবাদী কবিতাতে কবি লিখেছেন - ‘আন্দামানের বনে তুমি ঘুমোওনি একরাশি বছর।/ তোমার হৃদয়খানি পাথুরে দেশপ্রেমের সোনাকে/ তোমার চিন্তায় পুড়িয়ে খাঁটি করেছে মার্কস, লেনিন আর স্ট্যালিন। / চাটগাঁ থেকে তোমার তাড়িয়ে দিয়েছে চাটগাঁর মালিক’। সাম্যবাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়েও ধরা পড়ে একই সাম্যবাদের বাণী –‘ আমরা রোদ এনে দেব ছেলেটার গায়ে, / আমরা চাঁদা তুলে মারব কব কীট।/ কবি ছাড়া আমাদের জয় বৃথা।/ বুলেটের রক্তিম পঞ্চমে কে চিরবে / ঘাতকের মিথ্যা আকাশ ? / কে গাইবে জয়গান ?/ বসন্তে কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে / সে কিসের বসন্ত’?

এক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শিত পথের ভিন্নদিকের দিশারী। সুকুমার প্রেম, চাঁদ-ফুল-পাখির মতো বিলাসী কথা তাতে নেই, যা কিছু আছে তা স্পষ্ট ভাষায় লেখা। মানুষের জন্য মানুষের বেশে তিনি মানুষের প্রতি বিভিন্ন দাবিতে সোচ্চার, যে ভাষাতে সুপ্ত বিপ্লবের বীজ ঘুমিয়ে আছে –‘তবু উর্দ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত, / ঘর নেই জমি নেই পেটে নেই ভাত / ঘৃণায় ঘটায় অগ্ন্যুৎপাত, / উষ্ণ রক্তপাত।/ তাই,/ আরও ঘৃণা চাই’।

এই সমাজব্যবস্থাকে যাঁরা বার বার প্রতারণা করে চলেছে, এই কবিতা সেই অত্যাচারী মানুষের প্রতি, তাই যারা আজও বঞ্চিত, তারা দেশের সরকারের প্রতি আস্থা রাখে না, আজও যারা একটু ভাতের জন্য ভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের বেশে কাজে গিয়েছিলেন, তারা আজ খাবার পাচ্ছে না, একটু আশ্রয় পাচ্ছে না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি চুপ করে বসে থাকতে পারতেন লকডাউনে ভারতের বর্তমান অবস্থা দেখে?

ঋণঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা – যুগান্তর চক্রবর্তী

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More From Author See More