রাঢ় বাংলার অঘ্রাণ ও গ্রামে-গ্রামে বৈষ্ণবীয় ভোরাই 'টহল'

সেই সুদূর প্রাচীন থেকে রাঢ়দেশের মাঠ সেজে ওঠে পাকা ধানে, গ্রামের বাড়িগুলো ধানের মড়াই বা গোলাগুলো পরিষ্কার করা, নতুন ধান সেখানে রাখা হবে তার মধ্যে। হেমন্তের শুরুর মাস কার্তিকের সংক্রান্তিতে রাঢ়দেশে হয় 'মুঠপুজো'। সেদিন সকালে উঠে প্রত্যেক গৃহস্থের প্রধান স্নান করে শুদ্ধবসনে আড়াই আঁটি ধান কেটে মাথায় করে নিয়ে আসে বাড়িতে এবং সেই ধান খুব যত্নশীলভাবে পূজা করা হয়, বলা হয় ওই জমির ধানই কিছুদিন পর ঝাড়াই করে নবান্নের চাল তৈরি হয়। রাঢ়দেশের মধ্যযুগের ইতিহাস ঘাঁটলে আর একটি তথ্য উঠে যে - কার্তিক মাসে রাঢ়বঙ্গের সমৃদ্ধ বাড়িগুলোতে ঢেঁকিঘরে ঢেঁকিগুলো সারানো করা হতো, যাতে নবান্নের ধানকে সঠিকভাবে পেষাই করা যায়।

সে-কারণেই, কার্তিক মাস শেষ হলে আজও পয়লা অগ্রহায়ণ থেকেই শুরু হয়ে যাবে বিভিন্ন গ্রামের নবান্নের জন্য ধান ভাঙার কাজ, এই ধান ভাঙতে গেলেও শুদ্ধবসন পরিধানের রীতি চালু আছে। কার্তিকের পরে অঘ্রাণের আহ্বানের দিক খুঁজতে গেলে মধ্যযুগের কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লেখা ‘কালকেতুতে হেমন্তের কথা উঠে আসে। তিনি লেখেন -"হিমের প্রকাশ/যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।" মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতেও উঠে আসে হেমন্তের নতুন ধান কৃষকের ঘরে ঘরে সুখের আবেশের কথা। এ সময়ে তারা পরম তৃপ্তিতে সুখস্মৃতি নিয়ে আনন্দ বিলাসে মেতে ওঠে। রাঢ়বঙ্গের আর একজন বৈষ্ণব পদকর্তা লোচনদাসের পদে পাওয়া যায়- "অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে॥/পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।/সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে॥"  বৈষ্ণব পদকর্তাগণের মধ্যে গোবিন্দদাস রচিত পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। অঘ্রাণে কৃষাণ-কৃষাণীর সমৃদ্ধি ও সুখের সময়ে কুলবধূরা স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নায়রে গমন করে। তার রচিত পদে উল্লিখিত হয়েছে - "আঘাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/বৃন্দাবন বন ভেল॥" তাই মুঘল যুগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার রাজস্ব আদায়ের সময়কাল মুঘল বাদশা আকবর পয়লা অগ্রহায়ণ স্থির করেন, কারণ ধনী থেকে গরীব সবার গৃহ এই সময় মা লক্ষ্মীর কৃপাতে সমৃদ্ধ থাকে। যদিও এই সুসময়কাল শুরু হয় কার্তিকের শুরু থেকে। 

কার্তিকের আর একটি বিশেষ রীতির কথা না বললেই নয়, তা হল গোটা কার্তিক মাসের ভোরে বৈষ্ণবীয় ভোরাই গান, যেটির চল আছে বৈষ্ণবভূম উত্তররাঢ়ে। এখানে কেতুগ্রাম অঞ্চলের অন্যান্য গ্রামের মতো গঙ্গাটিকুরিতেও ভোররাতে (৩টের দিকে)  রাই-জাগো-রাই নামক বৈষ্ণব পদ গাইতে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে একজন গায়ক। খঞ্জনি হাতে অন্ধকারের ভেতরে সেই গান শুনতে শুনতে আধঘুমে মানুষ যেন প্রহর গোনে - এই বুঝি ভোর হয়ে এল..। এই পরিক্রমার ভার অনেককাল আগে থেকেই গঙ্গাটিকুরির একটি হাজরা পরিবারে দেওয়া আছে। সারা কার্তিক মাস গঙ্গাটিকুরির(২.৫ বর্গ কিমি)  সমস্ত পাড়া প্রদক্ষিণ করে এই ভোরাই পরিক্রমা সম্পন্ন হয় এবং এতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টার উপর। আধোশীতের সেই ভোরাইয়ের ভেতর দিয়েই সারা কার্তিক মাসে গঙ্গাটিকুরিতে সকাল হয়। শেষ রাতে ৩টে সময় গঙ্গাটিকুরি আদি ধর্মতলাতে এটা শুরু হয়ে, আবার সকালে এখানে এসেই শেষ হয়। কেতুগ্রামের প্রাচীন রীতি অনুসারে এখানে যেমন একজনই বৈষ্ণব পদ গাইতে গাইতে প্রদক্ষিণ করে সারাগ্রাম, ঠিক তেমনই পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর পাটুলি-শ্রীরামপুর অঞ্চলে গোটা একটা দল মিলে হরিনাম সংকীর্তন করে সারাগ্রামে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পাশের গ্রামের দল অন্য গ্রামে এসে হরিনাম গেয়ে যায় এবং এই কাজের জন্য তারা সেই গ্রাম থেকে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। 

পাটুলি-শ্রীরামপুর অঞ্চলে এই গ্রাম পরিক্রমাকে ভোরের 'নাম গান' বললেও কেতুগ্রাম তথা গঙ্গাটিকুরিতে এই বৈষ্ণবীয় ভোরাইকে 'টহল' বলে। অনেকের মতে, এই গানকে 'টহল' বলার পেছনে লুকিয়ে আছে একটি গুপ্ত ইতিহাস। উত্তর রাঢ়ে সেনবংশীয়দের রাজাদের পতনের পর মুসলিম আক্রমণ শুরু হলে গৃহস্থের সমৃদ্ধির সময় অর্থাৎ কার্তিক মাস জুড়ে পাহারা দেওয়া অর্থেও প্রচলন হতে পারে টহল গানের। এই টহলের পারিশ্রমিক হিসেবে গোটা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল-ডাল-আলু ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুকেই উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হয় সেই টহলদারি পরিবারকে। তারপর সমস্ত গ্রাম সম্মিলিতভাবে অঘ্রাণের যে দিনটিকে নবান্নের দিন হিসাবে ঘোষণা করে, সেই নবান্নের শীতের ভোরেও গোটা গ্রামকে টহল গান জাগিয়ে তোলে। বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল ও কুষ্টিয়াতেও কার্তিকের ভোরে বিশেষ বৈষ্ণবীয় ভোরাইয়ের চল আছে, যার আঙ্গিক অনেকটাই টহলের মতো। অনেকে বলেন- কার্তিকের টহল হল বৈশাখী সন্ধ্যার হরিনামের মতোই নিত্য রীতির একটি উল্টো প্রদর্শন। অনেকে বলেন, কাটোয়া মহকুমা তথা কেতুগ্রাম অঞ্চলের বৈষ্ণব পদকর্তাদের বাসভূমি হিসাবে এই বৈষ্ণবধর্ম সহবত হিসাবে এই টহল দানের প্রথার চল আছে সেই মধ্যযুগ থেকে। 

আরও পড়ুন
রহস্যময় বাঁকাউল্লা ও বাংলার প্রথম গোয়েন্দাকাহিনি

শহুরে জীবনে হেমন্ত প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও গ্রামে তার থাবা এসে এখনও পুরোটা গ্রাস করতে পারেনি। ক্ষয়িষ্ণুভাবে হলেও প্রতিটা  ঋতুর আলাদা স্বাদ টিকে আছে, তাই আধঘুমে হঠাৎ টহলের গান শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে যাওয়াটুকুর অলৌকিক আনন্দ আজও এই গ্রামাঞ্চলে, গঙ্গাটিকুরির মতো ছোট্টো জনপদে টিকে আছে বহাল তবিয়তে...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় : বাংলার প্রথম ‘ব্র্যান্ডেড’ সাংবাদিক-সম্পাদক?

More From Author See More