অপমানিত ব্যোমকেশের কাছেও, দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে 'সফল' বাংলার মহিলা গোয়েন্দারা

১৯৮৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল তপন সিনহার 'বৈদুর্য রহস্য' সিনেমাটি। অনেকেরই দেখা সিনেমা। একটি আশ্রমের গর্ভগৃহ থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী বৈদুর্য মণি। রহস্যের কিনারা করতে পুলিশের সঙ্গে হাজির প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সাসপেন্সের সঙ্গেই মিলেমিশে গিয়েছে হাস্যরস। অবশেষে রহস্যের কিনারা করা গেল। কিন্তু সেই সাফল্য পুলিশের নয়। মনোজ মিত্র অভিনীত প্রাইভেট ডিটেকটিভেরও নয়। রহস্যের কিনারা করলেন দুই মহিলা। যে দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আল্পনা গোস্বামী এবং মুনমুন সেন। মন্দিরের সেবিকার ছদ্মবেশে তাঁরাই ছিলেন 'গোয়েন্দা'। সিনেমার শেষ অঙ্কে চমক লাগবেই। সেদিনের দর্শক তো বটেই, আজকের দর্শকও চেনাজানা গোয়েন্দা কাহিনির সঙ্গে মেলাতে পারবেন না কিছুতেই।

আরও পড়ুন
ছদ্মবেশে তুখোড়, হাজারো রহস্য ভেদ করা ভারতের প্রথম মহিলা গোয়েন্দার গল্প

গোয়েন্দা কাহিনির ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমাগত অপরাধের প্রবণতা বাড়তে থাকলে সেই সময়কে তুলে ধরতেই এই নতুন ধরনের কাহিনি মলাটবন্দি হতে শুরু করে। অন্ধকার জগতের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে একটু একটু করে রহস্যের জাল গুটিয়ে আনেন গোয়েন্দা। সেই কাহিনির পরতে পরতে সাসপেন্স, অ্যাডভেঞ্চার। আর গোয়েন্দার চেহারাও তো সেইসঙ্গে মানানসই হতে হবে। মাথায় কালো টুপি, গায়ে জ্যাকেট আর ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে একটা স্মোকিং পাইপ বা চুরুট। এই চেহারাটা অবশ্য জনপ্রিয় করে তুলেছেন আর্থার কোনান ডোয়েল তাঁর শার্লক হোমস চরিত্রটিকে দিয়ে। তবে গোয়েন্দা বলতেই একজন পুরুষের কথাই মনে আসে। হাজার হোক, অপরাধীর প্রতিটা চক্রান্তকে নস্যাৎ করে লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকতে হবে তো! মিস মার্পল বা মিতিন মাসি যেন সেই তালিকায় খানিকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। অন্তত গোয়েন্দা গল্পের পাঠকরা কোনোদিনই মহিলা গোয়েন্দাদের দিকে সেভাবে দৃষ্টি ফেরায়নি।

আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু

সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলমে মিতিন মাসির আত্মপ্রকাশ ২০০২ সালে আনন্দমেলার পুজো সংখ্যায়। জনপ্রিয় হয়ে উঠতে আর সময় লাগেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও তাই লেখিকাকে একের পর এক কাহিনির অবতারণা করে যেতে হয়। বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম কোনো মহিলা গোয়েন্দা জনপ্রিয়তার স্বাদ পেল।

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

তবে, পুরুষ গোয়েন্দাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মহিলা গোয়েন্দাদের লড়াই কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। হ্যাঁ, লড়াই বলাই উচিৎ। সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তো পুরুষের সঙ্গে লড়াই করে এগোতে হয়েছে মেয়েদের। তাই সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বিন্দিপিসি যখন কাঁথা বুনতে বুনতে সমাধান করে ফেলেন বহুকাল আগের একটি হত্যারহস্য, তখন বিস্ময়ের ঘোর কাটতে বেশ সময় লাগে। বিশ শতকের গোড়াতেই অবশ্য সরলাবালা দাসী গোয়েন্দা কাহিনি লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর গোয়েন্দা চরিত্রটি পুরুষ। পাঠকের কাছে প্রথম ধারাবাহিক মহিলা গোয়েন্দার কাহিনি নিয়ে এলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, চারের দশকে। প্রকাশ পেল কৃষ্ণাকে নিয়ে লেখা গল্প। ওই যে লড়াইয়ের কথাটা বলেছিলাম, কৃষ্ণাকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হল খোদ ব্যোমকেশে কাছে।তবে এই ব্যোমকেশ কিন্তু শরদিন্দুর সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী নন। কৃষ্ণার বন্ধুস্থানীয়। কাজ করতেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে। পড়ুয়া কৃষ্ণার গোয়েন্দাগিরির কথা শুনে ব্যোমকেশ কৃষ্ণাকে অপমানও করলেও, শেষ পর্যন্ত মেনে নেন তাঁর প্রতিভা। কাহিনির শেষ স্তবক পর্যন্ত আসলে নারীবাদের উন্মেষকেই তুলে ধরেছেন লেখিকা। কৃষ্ণা তাই অবলীলায় বলতে পারে, "মেয়ে হয়ে মেয়েদের সাহায্য" করাই তার উদ্দেশ্য। তাঁর কাছেই পেয়েছিলাম আরেক মহিলা গোয়েন্দা শিখাকেও। কিন্তু ব্যোমকেশ-কিরীটি যুগলবন্দীর বিপরীতে কেউই বাজার দখল করতে পারেনি।

আরও পড়ুন
সাহিত্যে মিলিয়েছিলেন বাংলা আর ওড়িশাকে, ৯২ বছরে চলে গেলেন যুগলকিশোর দত্ত

এমনিভাবে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল। গোয়েন্দা কাহিনীর সাসপেন্স আর থ্রিল ততদিনে ছোটদের বেশ আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। এমন সময় ১৯৬১ সালে নলিনী দাশ লিখতে শুরু করলেন গোয়েন্দা গণ্ডালুর কাহিনি। চার বন্ধু কালু, মালু, টুলু আর বুলু। বোর্ডিং স্কুলের এই চার ছাত্রীকে নিয়েই গোয়েন্দা গণ্ডালু। হ্যাঁ, চারজনেই ছাত্রী। খুদে পাঠকদের কাছে এই কাহিনী খানিকটা জনপ্রিয়ও হয়েছিল।

আরও পড়ুন
অপরাধীকে শনাক্ত করবে তার কানের গঠনই, ১৪০ বছর আগে গবেষণা ফরাসি গোয়েন্দার

তারপর ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দার কথাই বা বাদ যায় কেন? সেখানেও তো বাবলু, বিলু, ভোম্বলের পাশেই জায়গা করে নিয়েছে বাচ্চু আর বিচ্চু। তবে পরিণত পাঠকরা আবারও পুরুষ গোয়েন্দাদের কাহিনীতেই মুখ ঢাকলেন।

আরও পড়ুন
গোয়েন্দা কাহিনি, জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান – বিভিন্ন নামে বই লিখেছেন এই বাঙালি

দেখতে দেখতে গল্পে উপন্যাসে ভিড় বাড়ছিল গোয়েন্দা চরিত্রের। তার মধ্যেই এসে গিয়েছেন সকলের হার্টথ্রব ফেলুদা। মহিলা গোয়েন্দার কাহিনি আবার ফিরে এলো সত্তরের দশকে মনোজ সেনের হাত ধরে। গোয়েন্দা দময়ন্তী সেনকে কেন্দ্র করে লিখে ফেললেন কয়েকটা গল্প। কিন্তু সে কাহিনিও বেশিদিন চলল না। মহিলা গোয়েন্দার কাহিনি অর্থনৈতিক সাফল্যের মুখ দেখল আশির দশকে এসে। অদ্রীশ বর্ধনের নারায়ণীকেই এক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা চলে। অথবা নব্বইয়ের দশকে গোয়েন্দা গার্গী। তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই চরিত্রটি আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় পাতায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। আর এভাবেই দেখতে দেখতে একটা শতাব্দী পেরিয়ে গেল। একুশ শতকের শুরুতেই আত্মপ্রকাশ করলেন প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি ওরফে মিতিন মাসি।

আরও পড়ুন
অস্থির সময়ের প্রতিবাদ সাহিত্যেই, নতুন ইস্তাহার প্রকাশ বাংলার সাহিত্যিকদের

বাংলার মহিলা গোয়েন্দাদের লড়াইয়ের সময়টা বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে। শুরুতেই বলেছিলাম বৈদুর্য রহস্য সিনেমাটির কথা। তার আগেই 'শেষ অঙ্ক' এবং 'কুহেলি' সিনেমাতে গোয়েন্দার চরিত্রে দেখেছি মেয়েদের। তারপর ঋতুপর্ণ ঘোষের 'শুভ মহরত' ছবিটির কথাই বা ভুলি কী করে? সেইসঙ্গে ফেলুদা ব্যোমকেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিনেমার পর্দায় এসে গিয়েছেন মিতিন মাসিও। আজকের কৃষ্ণাদের আর ব্যোমকেশের কাছে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে না নিশ্চই। প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রেই মহিলারা পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। দস্তুরমতো সফলও হয়েছেন প্রতিটা ক্ষেত্রে। তাই মিতিন মাসির সঙ্গে রহস্য সমাধান করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসেন তাঁর স্বামী। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে মেয়েদের লড়াইয়ের ইতিহাসটা যে থেকে গিয়েছে। বা বলা ভালো, আজও চলছে। গল্পের চরিত্রদের আমরা যত সহজে মেনে নিতে পারি, বাস্তবের মহিলাদের সেই সম্মান দিতে শিখেছি কি আমরা?

তথ্যসূত্র: মেয়ে গোয়েন্দার ইতিহাস, বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় (মেয়েরা যখন গোয়েন্দা, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)

More From Author See More