স্বীকৃতির খোঁজে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন, আবেদন জিআই-এর

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মেজ মেয়ে জিনাত-উন-নিশা। সম্রাটের কাছে নাকি একদিন ভারি বকুনি খেয়েছিলেন তাঁর পোশাকের জন্য। অত হাল্কা পোশাক সম্রাটের পছন্দ হয়নি। মোঘল রাজপরিবারে অবশ্য এই পোশাকের বেশ ভালোই চাহিদা ছিল। আর শুধু মোঘল পরিবারই কেন! বাংলার মসলিনের খ্যাতি তো তখন সারা পৃথিবী জোড়া। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে মসলিনের কাপড় নিয়ে।

আরও পড়ুন
গুটি তোলা থেকে শাড়ি বোনা – রেশম শিল্পে স্বনির্ভরতার আখ্যান গড়ছেন পূর্ণিয়ার মহিলারা

কত না মিথ গড়ে উঠেছে এই কাপড়কে ঘিরে। একটা শাড়ি নাকি এঁটে যায় একটা দেশলাই বাক্সের মধ্যে। ছোট্ট আংটির ভিতর দিয়ে গলে যায়। টলেমির ভূগোলে পর্যন্ত এই বস্ত্রের উল্লেখ আছে। ‘মাকড়সার জালের মতো’ এটাই বোধহয় মসলিন সম্পর্কে সবচেয়ে উপযুক্ত বিশেষণ ছিল। আর তারপর এল ইংরেজ বণিকরা। বাংলার মসলিনের ইতিহাস শেষ হল তখনই। শোনা যায়, নিজেদের মিলে তৈরি কাপড়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য ইংরেজরা নাকি এদেশের তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নিত। ফলে মসলিনের সুতোও হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল এই কাপড় বোনার কৌশলও। শুধু বাঙালির স্মৃতিতে থেকে গেল এই কাপড়।

আরও পড়ুন
মাটির কাছে বাস, রুজিও মাটির তালেই – রূপকথার যে গ্রাম আসলে এক পরিবার

স্বাধীনতার পর এদেশের শিল্পীরা চেষ্টা করেছেন সেই হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে উদ্ধার করতে। যদিও ‘ফুটি’ নামের সেই বিশেষ তুলা আর পাওয়া যায়নি। তবে মসলিনের বুনন বা নকশা আয়ত্ত করতে পেরেছেন তাঁরা। আর এই কাজে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামোদ্যোগ পর্ষদ’। সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে তৈরি হয়েছে ৬৩টি মসলিন ক্লাস্টার। এই কাপড়ের উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ৩৯,৫৮৩ জন তাঁতি। বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের কাপড়। আর এই শিল্পকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে তার ব্যবসায়ী দিকটাতেও গুরুত্ব দিতে চাইছেন খাদি ও গ্রামোদ্যোগ পর্ষদের কর্তারা। আর সেই লক্ষ্যেই তাঁরা আবেদন করেছেন জিআই সার্টিফিকেটের।

আরও পড়ুন
জাহাজ তাঁকে চিনিয়েছে পৃথিবী, কবিতা দিয়েছে ভাষা – এক বাঙালি নাবিকের গল্প

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো স্থানের বিশেষ বিশেষ উৎপাদনকে চিহ্নিত করে রাখা হয় এই জিআই ট্যাগ দিয়ে। তাতে যেমন বিশেষ কৃষিজ ফসল বা কৃষিজাত দ্রব্যও থাকে, তেমনি থাকে হস্তশিল্প সামগ্রীও। এই ট্যাগ নির্দিষ্ট অঞ্চলের ব্যবসার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই জিআই ট্যাগ পেতে এবার বাংলার ট্রাম্প কার্ড ‘মসলিন’। যদিও বাংলার পূর্বদিকে, মানে এখন যেখানে বাংলাদেশ সেখানেই মসলিনের উৎপাদন ছিল বেশি। আর মসলিনের আগে ‘ঢাকাই’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত আমরা সবাই। তবু পশ্চিমবঙ্গেও এই বস্ত্রের উৎপাদন বা চাহিদা কোনোটাই খুব কম ছিল না। এমনটাই দাবি পর্ষদের কর্তাদের। আর তার সঙ্গে মসলিনকে ঘিরে হাজারো মিথ আর ইতিহাস তো আছেই। তাই বিশ্বের বাজারে আরও একবার বাজিমাত করতে চলেছে বাংলা। আর সেটা মসলিনের হাত ধরেই।

Latest News See More