বাবার দেওয়া নাম ‘অ্যাক্রয়েড’, যৌবনে পৌঁছে প্রথম বাংলা শেখেন ‘সাহেব’ অরবিন্দ ঘোষ

কোন্নগরের বনেদি ঘোষ পরিবারের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ। পেশায় একজন চিকিৎসক। বাংলার বুকে কাজ করলেও বাঙালি আদবকায়দার কিছুই তাঁর ভালো লাগত না। একটা সময় উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সেখানকার পরিবেশ, আদবকায়দা দেখে তিনি যারপনাই মুগ্ধ। তখন থেকে কেবল বাহ্যিকভাবেই বাঙালি হয়ে রইলেন কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ; হাবে-ভাবে ফুটে উঠছে ইউরোপীয় চালচলন। তাঁর ইচ্ছে, ছেলেরাও যেন এমন শিক্ষা পায়। ‘নেটিভ’দের থেকে যেন দূরে থাকে। বড়ো দুই ছেলে মনমোহন ও বিনয়ভূষণকে পাঠিয়ে দিলেন দার্জিলিংয়ের কনভেন্ট স্কুলে। আর বাবার ইচ্ছায় দুই দাদার সঙ্গে ‘ইংরেজ’ হতে পাড়ি দিলেন অরবিন্দ ঘোষও…

মাতামহ রাজনারায়ণ বসু ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সম্মাননীয় ব্যক্তি। বাড়িতে সাহিত্যের চর্চা তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। ছোট্ট অরবিন্দ তাঁর কাছেই বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু সেখানেই ছেদ পড়ল। বাবার ইচ্ছা যে অন্য! জীবনের শুরুর দিকে কৃষ্ণচন্দ্রের যথেষ্ট প্রভাব ছিল অরবিন্দের ওপর। তাতে তিনি খুশি ছিলেন কিনা, জানা যায় না। কিন্তু বাবার দেখানো রাস্তাটি ধরেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যার মাতামহ বাংলা ও বাঙালি সমাজের এমন শ্রদ্ধেয় পুরুষ; তিনি ছোটো বয়সে বাংলাই জানলেন না! ইংরেজি আর হিন্দিতেই চলত কথাবার্তা, চলত শিক্ষার আদানপ্রদান। অরবিন্দদের সাহেবি হয়ে উঠতে হবে যে! 

দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হল অরবিন্দের শিক্ষা। দেশের ঐতিহ্য, বাংলার ইতিহাস, বাংলা ভাষা এবং সমকালীন স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে তিনি ছিলেন বেশ অনেকটাই দূরে। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রবল ইচ্ছা, ছেলে তাঁর মতো ডাক্তার হোক; এবং পরবর্তীতে যেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করুক। ওঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করলে শিক্ষার ছাপ থাকবে। কিন্তু এদেশে থাকলে তো এত শিক্ষা হবে না! ওঁদের তো বাইরে পাঠাতে হবে! বিশেষ করে, সিভিল সার্ভিসের জন্য ইংল্যান্ডে আওয়া বাধ্যতামূলক। কৃষ্ণচন্দ্র ঠিক করলেন, ছোটো বয়সেই যদি অরবিন্দ বিলেতে পড়াশোনা শুরু করে, তাহলে তাঁর মানিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না। সেই চর্চায় ছোটো থেকে বেড়ে উঠলে পরবর্তীতে আর চিন্তা থাকবে না। বাবাও খুশি, ছেলের ভবিষ্যৎটা এবার তৈরি হবে। অতএব, জাহাজে উঠলেন বছর সাতেকের অরবিন্দ ‘অ্যাক্রয়েড’ ঘোষ। হ্যাঁ, বাবা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথমে এমনই নাম রেখেছিলেন ছেলের… 

ছোটো থেকেই অরবিন্দ বাকি ভাইদের থেকে একটু আলাদাই ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী, স্কুলের পড়া করতে বেশি সময়ই লাগে না তাঁর। রেভারেন্ড ডব্লিউ এইচ ড্রেওয়েট এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে একটু একটু করে এগোতে থাকে ভাষাচর্চা। ইংরেজি, গ্রিক, ফরাসি, ল্যাটিন, জার্মান— একের পর এক ভাষা শিখতে শুরু করেন অরবিন্দ। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সবকিছু মিলে এগোনো শুরু করলেন তিনি। আর মাঝেমধ্যেই ডায়েরির পাতা ভরে যেতে থাকল কবিতায়। কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে ব্রাত্য থাকল বাংলা, বাংলার ঐতিহ্য; এবং অবশ্যই, ভারত। বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল কিনা! 

কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র বোধহয় নিজের ছেলেকে বুঝতে পারেননি। দেশ থেকে বহু দূরে থাকলেও, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত খবরই পৌঁছে যেত তাঁর কাছে। সেন্ট পলস বিদ্যালয়, কেমব্রিজের কিংস কলেজ— সমস্ত জায়গায় পড়াশোনা এগিয়ে যাচ্ছিল তরতর করে। কৃষ্ণচন্দ্রও যথেষ্ট খুশি। অরবিন্দ তাহলে আইসিএস পরীক্ষায় বসবে; এবং তিনি নিশ্চিত, ছেলে ভালো ফল করবেই। অথচ ভেতরে ভেতরে ভারতের যাবতীয় খবরই রাখছিলেন অরবিন্দ। একটু একটু করে দেশের পরিস্থিতি বুঝলেন। এবং যত ভেতরে ঢুকলেন, ততই বিদেশের জীবন অসহ্য লাগতে শুরু করল। তখনও বিদেশি কায়দায় ‘Aaravind Ghose’ বানান লিখছেন তিনি। নামের মধ্যে জুড়ে আছে ‘অ্যাক্রয়েড’ শব্দটি। 

একসময় চলে আসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সময়। বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় বসলেন অরবিন্দ। বাবার কথার অমান্য তখনও করেননি তিনি; কেবল সুযোগ খুঁজছেন খাঁচা খুলে বেরনোর। ২৫০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১তম স্থান অর্জন করলেন তিনি। এর পরের ধাপ ঘোড়ায় চড়া। এটাই সুযোগ! এখানে অকৃতকার্য হলে ফিরে যেতে হবে তাঁকে। ইচ্ছে করে সেই কাজটিই করলেন অরবিন্দ ঘোষ। সত্যি কি সেইজন্যই বাদ পড়েছিলেন তিনি? কারণ, কেমব্রিজে পড়ার সময়ই বেশ কিছু বক্তৃতা দিয়েছিলেন অরবিন্দ, যার ছত্রে ছত্রে ছিল বিপ্লবী চিন্তাধারা এবং স্বাধীনতার চিন্তা। ততদিনে স্বাধীনতার চেতনা তাঁর ভেতরে ঢুকে গেছে। তাহলে কি এইজন্যই বাদ পড়েছিলেন তিনি? জানা যায় না। তবে এরপরই ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন অরবিন্দ ঘোষ। বিলেতের জীবনের প্রতি কোনোরকম আসক্তি ছিল না তাঁর। জাহাজে যখন উঠলেন, সেই সময় আরও একটি কাজও করলেন। তাঁর মধ্যনাম ‘অ্যাক্রয়েড’ চিরজীবনের মতো ত্যাগ করলেন। এবার থেকে তাঁর পরিচয় কেবল এবং কেবলই অরবিন্দ ঘোষ নামে… 

আসার সময়ই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। অরবিন্দের জাহাজটি মুম্বইতে অবতারণ করার কথা ছিল। সেইজন্য বাবা কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। মনমোহন ও বিনয়ভূষণ তখনও বিলেতে; তাঁরা তখন পুরোদস্তুর সাহেব। হঠাৎই মুম্বইতে খবর এল, অরবিন্দ ঘোষ যে জাহাজটিতে আছেন, সেটি ডুবে গেছে। অবশ্যই এটি ভুয়ো খবর ছিল; কিন্তু এর ফল হল মারাত্মক। এই ‘ধাক্কা’ নিতে পারেননি অসুস্থ কৃষ্ণচন্দ্র। মুম্বইতে নেমে অরবিন্দ শুনলেন, বাবা আর নেই। এরপর বাংলায় নয়, সরাসরি চলে গিয়েছিলেন বরোদায়। সেখানে কলেজের অধ্যাপক হিসেবে শুরু হয় নতুন জীবন। এই প্রথম ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। দেখলেন চারিদিকের পরিস্থিতি। সামনে পেলেন ছোটো ভাই বারীন্দ্রকে। এবার শুরু করলেন বাংলা ভাষা শেখা… 

‘সাহেবি’ থেকে ‘বিপ্লবী’, তারপর ‘সাধক ঋষি’— অরবিন্দ ঘোষের সবকটি সত্তার বিবর্তন টের পাওয়া যায় তাঁর নামের বানান থেকে। ছোটো থেকে ‘Aaravind Ghose’ লিখে অভ্যস্ত; পরবর্তীতে যখন বরোদায় চাকরি করছেন তখন নিজের নামের বানান বদলে ফেলেছেন তিনি। তখন তিনি ‘Aravind’ এবং ‘Arvind’। বঙ্গভঙ্গের সময় যখন কলকাতার বিপ্লবী জগতে পা রাখলেন, তখন তিনি বদলে গেলেন ‘Aurobindo Ghosh’-এ। বিলেতি সত্তা ছেড়ে যেন নবজন্ম হল তাঁর। হয়ে উঠলেন ব্রিটিশদের ত্রাস। কলকাতার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠলেন তিনি। বাকিটা তো ইতিহাস। সে প্রসঙ্গ না হয় থাক আজ। 

তথ্যসূত্র-

১) ‘নিজের কথা’/ অরবিন্দ ঘোষ 

২) ‘অরবিন্দ ঘোষ’, সব বাংলায় 

৩) ‘‘ইংলিশম্যান’ Aaravind Ghose হয়ে গেলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, অদ্ভুত এই পরিবর্তন’, সৌপ্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা ২৪x৭

Powered by Froala Editor

More From Author See More