রহস্যময় বাঁকাউল্লা ও বাংলার প্রথম গোয়েন্দাকাহিনি

বাঁকাউল্লা নাকি বরকতউল্লা? সত্যি গোয়েন্দা নাকি কাল্পনিক চরিত্র? সন্দেহ বিস্তর। নিষ্পত্তি দুরস্ত। এইসব খুঁজে বের করতেও আরেকটি গোয়েন্দার খুব দরকার। টাইম-ট্র্যািভেল করতে পারে, এমন গোয়েন্দা পেলে আরো ভালো। অনুপায়ে সেসব সরিয়ে রেখে, আপাতত গল্পে মন দেওয়া যাক।

বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পের সূত্রপাত 'বাঁকাউল্লার দপ্তর' দিয়ে। টানটান-উত্তেজনায়-ভরা একডজন গোয়েন্দা গল্প। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী আনুমানিক কুড়ি-পঁচিশ বছর হল বাঁকাউল্লার কীর্তিকলাপের সময়কাল। সে সময়ের বাংলা, ব্রিটিশ জমানার সূত্রপাতে এদেশীয় জমিদারি প্রথা এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত পুলিশি ব্যবস্থার বাস্তব দৃশ্যায়ন ধরা পড়ে বাঁকাউল্লার দপ্তরে। 

এমনিতে বাংলার ডাকাতদের উপদ্রব কোনোদিনই হেলাফেলার  ছিল না। ফাঁসুড়ে ডাকাত হোক, ঠগী হোক, আবার রবিনহুড-গোত্রেরই হোক না কেন। পেল্লায় তাদের চেহারা, তেমনি বাহুবল ও বুকভরা সাহস। নৃশংসতা করতে এতটুকু হাতও কাঁপত না তাদের। দ্যাখ না দ্যাখ নরবলি দিতে পারত। কাটা মুণ্ডু ঝুলিয়ে রাখতে পারত। ফলে সাধারণ মানুষের কলজে ডাকাতের নাম শুনলেই কাঁপত। ইংরেজরা এদেশের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার পর, ঠগী দমন করতে উঠেপড়ে লাগে। লর্ড কর্নওয়ালিসের তত্ত্বাবধানে প্রথম থানা ও গোয়েন্দাব্যবস্থার সূচনা হয়। আর। তারপর ১৮৩৯ সালে ঠগী দমনের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা বিভাগের সূত্রপাত। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে, অভিযান চালিয়ে ঠগীদের হাত থেকে রেহাই মিলেছিল। এইসময়ই গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন বাঁকাউল্লা। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তিনি। বয়স যখন ২০-২১, মাদ্রাসার পড়া প্রায় শেষের মুখে, কোরান তাঁর প্রায় মুখস্থ - এমতাবস্থায় পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগে বাঁকাউল্লার চাকরি। লর্ড হেস্টিংস থেকে হার্ডিঞ্জ পর্যন্ত অনেকেই বিস্তর চেষ্টা করেছেন ঠগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে, কিন্তু কেউই আর সফল হতে পারেননি। ফলে, ঘুরে ঘুরে পুলিশি নিয়োগ চলছে। ভদ্র শিক্ষিত উৎসাহী যুবকদের চাকরির অবাধ সুযোগ। বাঁকাউল্লার চাকরিলাভ।  এরপর থেকে তার রোমাঞ্চকর অভিযান। 

সেসব অভিযান পড়লে, আজকের তদন্তগুলিকে কেমন ফিকে মনে হয়। ফরেন্সিক রিপোর্টের সুবিধা তো ছিল না। সিসিটিভি বা এথিক্যাল হ্যাকারদের চিহ্ন নেই তখন। দিন গড়িয়ে, হপ্তা গড়িয়ে মাসে পৌঁছত তদন্ত। দিনের পর দিন নানাস্থানে অপরাধীর খানাতল্লাসি চালাতে হত। প্রমাণ জোগাড়ের জন্য কতরকম কাঠখড়ই না পোড়াতে হত। 'বাঁকাউল্লার দপ্তর' থেকে জানা যায় সেসব কথা। অপরাধী অনেকসময়ই গ্রামের গণ্যমান্য সজ্জন ব্যক্তি। অনেকক্ষেত্রে জমিদার নিজেই। তাদের লোকবল প্রতিপত্তি কিচ্ছুটি কম নয়।  নানা ছদ্মবেশ নিয়ে ফাঁদ পেতে অপরাধী ধরতে হত, প্রমাণ খুঁজতে হত। কখনো কখনো রহস্যের কিনারা করতে প্রবেশ করতে হত হিন্দুর অন্দরমহলেও। মুসলমান বাঁকাউল্লা আশ্চর্য দক্ষতায় সেসবেরও সমাধান করেছেন গল্পে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে, তাদের আস্থাভাজন হয়েছেন। ওপর থেকে ক্ষমতার পরোয়ানা নিয়ে হাজির হননি অপরাধীর চৌকাঠে। আর অপরাধীরাও কিন্তু নানান সম্প্রদায়ের মানুষ। জমিদার,  সম্ভ্রান্ত হিন্দু, কায়স্থ বংশের সন্তান, মুসলমান - মিলিয়ে মিশিয়ে অপরাধীর ক্ষেত্র বিস্তৃত। তাদের মগজাস্ত্রও কম ধারালো ছিল না। চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে হত বাঁকাউল্লাকে সামাজিক, ধর্মীয় রীতিরেওয়াজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে। গল্পগুলির বর্ণন রীতিও এমন যে, শেষ না করা অবধি ওঠা যায় না।

এই বাঁকাউল্লার আসল নাম বরকতউল্লা বলে সুকুমার সেন দাবি করেছেন। ১৮৬৭ সাল নাগাদ ভারত সরকার বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসারের অধীনে চারজন বাঙালি অফিসার, আবার তাদের অধীনে ছিল বারোজন হেডকনস্টবল। এর মধ্যে একজন বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল, যার নাম বাকাউল্লা। এই বাকাউল্লাই কি বাঁকাউল্লা?  নাকি বরকতউল্লা - এসব নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। আনুমানিক ১৮৯৬ সালে বাঁকাউল্লার দপ্তর প্রকাশিত হয়। সমস্তটাই উত্তম পুরুষে লেখা। হতে পারে, বাঁকাউল্লা নামের দারোগা, গোয়েন্দার আত্মজীবনী এটি। গবেষকদের অনেকের মতেই, অবসর নেওয়ার পর বাঁকাউল্লার মুখ থেকে তাঁর কীর্তিকলাপের কথা শুনে কেউ একজন অনুলিখন করেছেন। আবার কারো মতে সেই গল্পগুলি 'দারোগা দপ্তর'এর রচয়িতা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। আবার কারো মতে, বটতলা যুগের সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। গল্পগুলির লেখক যেই হন না কেন, সমকালীন সমাজ ও পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল। বিশ শতকের গোয়েন্দাগল্পগুলি নিয়ে মাতামাতি আমাদের বেশি, তার প্রচারও ঢের বেশি। কিন্তু বাঁকাউল্লার দপ্তর কম যায় না এতটুকু। এক ভ্রাম্যমাণ গোয়েন্দাচরিত্র, অকুতোভয়, ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি, বাহুবল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা- সব মিলিয়ে বাঁকাউল্লার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন। উপরি পাওনা দুশো বছরের পুরোনো বাংলাদেশ, মানুষের জীবনযাত্রা।

ঋণ:  'বাঁকাউল্লার দপ্তর',  প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত ও সৌম্যেন পালের সম্পাদনা, চর্চাপদ

আরও পড়ুন
‘আমার দুর্ভাগ্য, মরার বয়সে পাণ্ডব গোয়েন্দার এই পরিণতি দেখে যেতে হল’ : ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

'উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান', সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ

Powered by Froala Editor