ফেলুদার ‘গুরু’ শার্লক হোমস জড়িয়ে ভারতের সঙ্গেও, ওয়াটসনও ডাক্তারি করেছেন এ-দেশে

লন্ডনে একটি রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘদেহী এক বাঙালি। তদন্তের কাজে এখানে এসেছেন তিনি। রাস্তাটার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি একটিই কথা বললেন, "গুরু তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি।" ফেলুদার সঙ্গে এভাবেই পরিচয় ঘটে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের। আর গুরু? শার্লক হোমস!

সত্যিই তো! বাঙালির গোয়েন্দাগিরির আইকন যে মানুষটি, তাঁর ‘গুরু’কে না চিনলে হয়! অবশ্য তাঁকে চেনানোর বিশেষ দরকার নেই; নিজের নামেই স্বনামধন্য তিনি। লন্ডন, বেকার স্ট্রিট আর শার্লক হোমস— একেবারে এক সুতোয় বাঁধা! শুধু কি শার্লক? ডঃ ওয়াটসন, মেরি, মাইক্রফট, লেস্ট্রাড, মরিয়ার্টি— একের পর এক চরিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে। প্রতিটা ঘটনা যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে আমাদের, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের এমন ‘উপহার’ কি ভুলে থাকা যায়! 

নানা ধরণের কেস সলভ করেছেন শার্লক আর ওয়াটসন। বারবার বিপদের মুখেও পড়েছেন। আর এই দুজনের সঙ্গেই নানাভাবে জড়িয়ে আছে এই দেশ। হ্যাঁ, ভারত! উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে শার্লক হোমসের গল্প প্রকাশ করতে শুরু করেন আর্থার কোনান ডয়েল। সেই সময় ভারত ইংরেজদের অধীনে। সিপাহী বিদ্রোহের খবর সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের মতো ‘সোনার রাজহাঁস’-এর প্রতিটা খবরের দিকে লক্ষ্য রাখছিল ব্রিটেন। সিপাহী বিদ্রোহ ও অন্যান্য খবর নজর এড়ায়নি কোনান ডয়েলেরও। শার্লক হোমসের বেশ কিছু গল্পে তাই ফিরে ফিরে এসেছে ভারত। 

ধরা যাক ডঃ জন ওয়াটসনের কথা। শার্লক হোমসের বন্ধু এবং সহকারী, প্রতিটা অভিযানের সঙ্গী। প্রথম উপন্যাস ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’-এ তাঁর আগের জীবনের সম্পর্কে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল সেটা একবার মনে করুন। ব্রিটিশ আর্মির ডাক্তার হিসেবে তিনি গিয়েছিলেন ভারতে। সেখানেই দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সময় গুরুতর আহত হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। সেই মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি প্রথম দিকে। এমন মুহূর্তেই তাঁর সঙ্গে শার্লক হোমসের আলাপ। এভাবেই এগোতে থাকে গল্প। এছাড়াও ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য স্পেকলড ব্যান্ড’-এর চরিত্র ডঃ গ্রিমসবি রয়লটও ভারত থেকে ইংল্যান্ডে। ভারতে থাকাকালীনই ঘটিয়েছিলেন একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তারপর? রহস্য এগোতে থাকে… 

এই পুরো অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে আছে আর্থার কোনান ডয়েলের জীবনও। ১৮৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে দেখছিলেন ভারতের পরিস্থিতি। অন্যান্যদের মতো তাঁরও উৎসাহ ছিল এই নিয়ে। তাই কেবল চরিত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেননি এই দেশকে। শার্লক হোমসের একটা আস্ত প্লট তৈরি হয়েছিল ভারত এবং এর ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। নাম ‘দ্য সাইন অফ ফোর’। শার্লককে নিয়ে ডয়েল যে চারটে উপন্যাস লিখেছিলেন, তাঁর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। সিপাহী বিদ্রোহ, চুরি হয়ে যাওয়া একটি গুপ্তধন এবং ভারতবর্ষ— এই সব মিলিয়ে টানটান গল্প। যেখানে অন্যতম মূল চরিত্রদের মধ্যে তিনজন ভারতীয়— দোস্ত আকবর, মাহমেত সিং এবং আব্দুল্লাহ খাঁ। তদন্ত, গোয়েন্দা কাহিনি ছাড়াও ভারতের সমাজ, সেখানকার জাতিভেদ প্রথা ও সেই সময়ের কথাও উঠে এসেছে। এই গল্পেই এসেছিলেন মেরি মরস্টান, যিনি পরবর্তীকালে জন ওয়াটসনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন… 

এই উপন্যাসের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষও একটা বড়ো জায়গা জুড়ে আছে। সেটা কি স্যার আর্থার কোনান ডয়েলেরই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে? ঐতিহাসিকরা সেই কথার দিকেই জোর দিচ্ছেন। কারণ এই দেশে কখনও পা পড়েনি তাঁর। কোনান ডয়েলের কাছে ভারত ছিল ‘রহস্যময়’ একটি দেশ। ‘দ্য সাইন অফ ফোর’-এর টুঙ্গা নামের আন্দামানে বসবাস করা চরিত্রটির জন্য বেশ সমালোচনার মুখেই পড়তে হয় তাঁকে। কারণ, বর্ণবিদ্বেষ! সেটা কি কেবল তাঁর একারই চিন্তা! সেই সময়ের ইতিহাস অন্তত অন্য কথা বলে। সব মিলিয়ে শার্লক হোমস এভাবেই ভারতের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন চিরকালের জন্য। আর পরবর্তীকালে তাঁর একলব্য তো নিজে বেকার স্ট্রিটে গিয়েই শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। ফেলুদার অমন কথা কি ভোলা যায়! 

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More