শিশুদের জন্য ছিল শয়নকক্ষের ব্যবস্থাও; উত্তরপাড়ার ‘গৌরী সিনেমা’ ও একটি বাসের গল্প

ইতিহাস মুছে গেলেও তার কিছু চিহ্ন রেখে যায়। মানুষের মুখে মুখে থেকে যায় অস্তিত্ব। এই শহর কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে একটু মফঃস্বলের দিকে গেলেই উত্তরপাড়ার একটি বাস স্টপেজের নাম ‘গৌরী সিনেমা’। এই নামেই যাত্রীরা টিকিট কাটছেন, জায়গামতো নেমে যাচ্ছেন। অথচ নেমে সিনেমা হল খুঁজতে গেলেই হতাশ হতে হবে। কোথায় সিনেমা হল? একটা অতি পুরনো বাড়ি আছে ঠিকই। তবে তার নিচে আছে কিছু খাবারের দোকান। কয়েকটা সেলাইয়ের দোকান। আর ওপরে আছে ছাত্রাবাস এবং মেসবাড়ি।

তবে আর একটু খুঁজলেই সেই বাড়ির মধ্যে প্রাচীন সিঙ্গেল স্ক্রিন হলটির খোঁজ পাওয়া যাবে। এখন তার সামনে তালা ঝুলছে। শহর কলকাতা থেকে মফঃস্বলের নানা শহরে এমন কত সিঙ্গেল স্ক্রিনই তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে একসময় এই হলগুলির সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল মানুষের যাপন। শুধুই সিনেমার বাণিজ্য নয়, হলগুলি যেন ছিল এক অস্থায়ী সংসার। এই গৌরী সিনেমাতেই নাকি ছিল ‘শিশু শয়নকক্ষ’। নতুন দম্পতির নাইট শো-এর জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। হলে ঢোকার আগে শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যেতেন এই নির্দিষ্ট ঘরে। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেলে দেখাশোনার জন্য দক্ষ কর্মচারীও থাকত। সিনেমা দেখে বেরিয়ে বাবা-মা আবার তাঁদের সন্তানকে খুঁজে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।

শোনা যায়, এই গৌরী সিনেমারই পুরনো নাম পার্বতী সিনেমা। তবে তখন ঠিকানা ছিল উত্তরপাড়া স্টেশনের কাছে। ১৯৪৪-৪৬ সাল নাগাদ সেই হল উঠে আসে জিটি রোডের ধারে। আর নাম বদলে হয় গৌরী সিনেমা। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রমরম করে চলেছে সেই সিনেমা হল। তবে এরপরেই ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। ততদিনে ঘরে বসে ভিসিআর-এ সিনেমা দেখার রেওয়াজ এসে গিয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই তো সিডি ক্যাসেটে ছেয়ে যাবে বাজার। পাইরেসির ধাক্কায় সামগ্রিকভাবে সিনেমার ব্যবসাই ক্ষতির মুখে পড়েছিল। গৌরী সিনেমাকেও লড়াই করতে হয়েছে সেই বদলে যাওয়া বাজারের সঙ্গে। ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত কোনোরকমে ব্যবসা চলেছে। এর মধ্যেও কয়েকবার বন্ধ হয়েছে, কয়েকবার মালিকানা হাতবদল হয়েছে। তবে ৯০-এর দশকে এসে আর দর্শকের মুখ দেখল না গৌরী সিনেমা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন কতকিছুই হারিয়ে যায়। গৌরী সিনেমার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ৩-নং বাস রুট। যে বাস চলত শ্রীরামপুর থেকে খোদ বাগবাজার পর্যন্ত। সেই বাসও বন্ধ হয়ে যাবে বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে বহুদিন। লকডাউনের পর তার যাত্রাপথও কমিয়ে আনা হয়েছে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত। এই সবকিছুই হয়তো একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে। তবে মানুষের মুখে মুখে সেই ইতিহাস জীবন্ত হয়ে থাকবে নিশ্চিত।

আরও পড়ুন
লুসিবাবুর স্মৃতি আর বিশ্বযুদ্ধের প্রতিপত্তি নিয়ে আজও জনপ্রিয় উত্তরপাড়ার প্রাচীনতম রেস্টুরেন্ট

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মানব হৃৎপিণ্ডের বিকল্প যন্ত্র তৈরি করে জাতীয় পুরস্কার উত্তরপাড়ার সুমন্তের

More From Author See More