মানব হৃৎপিণ্ডের বিকল্প যন্ত্র তৈরি করে জাতীয় পুরস্কার উত্তরপাড়ার সুমন্তের

এমনই একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা কাজ করবে হুবহু মানুষের হৃদপিণ্ডের মতো। টেবিলে রেখেই পরীক্ষা করা যাবে মানুষের হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা। প্রয়োজনমতো যান্ত্রিক পরিবর্তন করে তৈরি করে নেওয়া যাবে যে কোনো কার্ডিওভাসকুলার অসুস্থতার উপসর্গ। প্রযুক্তির মাধ্যমে এমনই অভিনব এক যন্ত্র তৈরি করছেন খড়গপুর আইআইটির বাঙালি গবেষক সুমন্ত লাহা। আর তার সুবাদেই আরও একবার দেশের মধ্যে সেরার শিরোপা এল বাংলায়। 

সম্প্রতি এই উদ্ভাবনীর জন্য সুমন্ত লাহা পেলেন জাতীয় পুরস্কার। গান্ধীয়ান ইয়ং টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন ২০২০-র সিটিআরএ (সিতারে) বিভাগে সম্মানিত হলেন তিনি। উল্লেখ্য, এই বছর জিওয়াইটিআই সম্মানের ২১টি পুরস্কারের মধ্যে চারটিই এসেছে খড়গপুর আইআইটিতে। গত ৫ নভেম্বর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক ডঃ হর্ষবর্ধন এই পুরস্কার তুলে দেন কৃতি গবেষকদের হাতে। তবে মহামারীর আবহে অনলাইন কনভোকেশনই ছিল একমাত্র রাস্তা।

বায়োটেকনোলজি, কৃষি, চিকিৎসা ও শিক্ষা - এই চার বিষয়েই দেওয়া হয় সিতারে সম্মান। হেলথ-কেয়ার বিভাগে সেরা হিসাবে বিবেচিত হয়েছে গবেষক সুমন্ত লাহার প্রোজেক্ট ‘কার্ডিওভাসকুলার রেপ্লিকেটর’। এই যান্ত্রিক ব্যবস্থা মানবদেহের হৃদযন্ত্রের মতোই কাজ করে তা তো স্পষ্টই। তবে কেমনভাবে কাজ করে এটি? 

“মানুষের হৃদপিণ্ডের গঠন মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই যন্ত্রটি। এখানেও রয়েছে চারটি প্রকোষ্ঠ, চারটি ভাল্ভ। যেকোনো ভাল্ভের পরিবর্তন করে বদলানো যায় রক্তপ্রবাহ, রক্তের চাপ এবং অন্যান্য পরামিতিগুলি। রক্তের বদলে একই ঘনত্বের অন্য তরলের ব্যবহারে মানবদেহের হৃদযন্ত্রের প্রতিস্থাপক হিসাবে কাজ করানো যায় এই যন্ত্রকে। তরলের পরিচলনের জন্য রয়েছে কৃত্রিম ইলেক্ট্রনিক পাম্পের ব্যবস্থা। পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীর সংযোগে যন্ত্রের কার্যকারিতার সমস্ত পরিসংখ্যানই পাওয়া যাবে ডিজিটালি”, বলছিলেন সুমন্তবাবু স্বয়ং।

তবে এই যন্ত্রের বাড়তি কার্যকারিতা কী? সুমন্তবাবু জানালেন, “এই যন্ত্র তৈরির উদ্দেশ্য ছিল মূলত তিনটি। প্রথমত, মানুষের হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সেগুলো ঠিক কতটা কাজ করতে পারছে, না পারছে তা পরীক্ষা করা যাবে এই যন্ত্রে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থাতেও আমূল পরিবর্তন আসবে এই যন্ত্রের ব্যবহারে। শিক্ষার্থীরা সরাসরি হৃদযন্ত্রের ব্যবহারিক কাজগুলি বুঝতে পারবেন এর মাধ্যমে। তাছাড়াও, ভাল্ভগুলির মাধ্যমে এর মধ্যে যেকোনো কার্ডিওভাসকুলার অসুস্থতার উপসর্গ তৈরি করা যাবে। এবং সেই উপসর্গগুলির বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের ফলে অনেক সহজ হয়ে যাবে চিকিৎসার কাজ।” 

আরও পড়ুন
অন্ধকারেও উজ্জ্বল বৃহস্পতির উপগ্রহ, রহস্যভেদ ভারতীয় বিজ্ঞানীর

হ্যাঁ, এমনই যুগান্তকারী এক গবেষণাই এই তরুণ গবেষকের মস্তিষ্কপ্রসূত। মানবদেহে এর ব্যবহারিক কোনো প্রয়োগ না থাকলেও, এই যন্ত্র ভোল বদলে দিতে পারে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের। 

সুমন্তবাবুর বেড়ে ওঠা হুগলির উত্তরপাড়ায়। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠে। বাদ্যযন্ত্র আর ফটোগ্রাফির শখের সঙ্গে স্কুলবয়স থেকেই নতুন কিছু সৃষ্টির নেশা ঘিরে ধরেছিল সুমন্তবাবুকে। উদ্ভাবনী শক্তি আর বিজ্ঞান মিলে-মিশে গিয়েছিল সেই ছোট্ট বয়সেই। ২০১১ সালে হুগলি বিজ্ঞানমেলায় দ্বিতীয়ের সম্মান দিয়েই শুরু হয়েছিল একটা পথ। ২০১৬ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় সারা পূর্বভারতে বিআইটিএম সম্মানের সেরার মুকুট ওঠে তাঁর মাথায়। আর সেই জার্নির সাম্প্রতিক স্টপেজই হল জাতীয় পুরস্কার।

আরও পড়ুন
ভেজা কাপড় থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় পুরস্কার বাঙালি গবেষকের

বিজ্ঞানের আর প্রযুক্তির ওপর ভালোবাসা থেকেই মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শুরু করেছিলেন পড়াশোনা। ঠিকানা হল লিলুয়ার এমসিকেভি ইনস্টিটিউট। তবে পড়াশোনা শেষ করার মানেই চাকরি জীবনে ঢুকে পড়া। কারণ একটু একটু করেই সে বয়সে বাড়তে থাকে পরিবারের দায়িত্ব। সুমন্তবাবুর ক্ষেত্রেও হয়েছিল তেমনটাই। কাজ শুরু করেছিলেন একটি যান্ত্রিক প্রযুক্তির কোম্পানিতে। 

তবে নতুন চাকরিতে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিলেন, ছোটো হয়ে এসেছে পরিধি। রুটিনে বাঁধা জীবনে হারিয়েছে নিজের উদ্ভাবনীকে ঝালিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতাটুকুও। কাজেই সে জীবনে আর কতদিন টিকে থাকা যায়। আবার চাকরি ছেড়ে ফিরলেন অ্যাকাডেমিক জীবনে। খড়গপুরে শুরু হল যান্ত্রিক প্রযুক্তি বিভাগে স্নাতকোত্তর করা। অদূরেই বিষয় হয়ে উঠল চিকিৎসাগত প্রযুক্তিবিদ্যা বা বায়োটেকনোলজি। শুরু হল নতুন গবেষণা। বিষয় এতটাই আকর্ষণীয় ছিল সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল আইসিএমআরও। খড়গপুর আইআইটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডঃ পি.কে. দাস গবেষণায় সাহায্য করেছেন অক্লান্তভাবেই। পুরো প্রকল্পেই পাশে থেকে একইসঙ্গে লড়ে গেছেন সহকারী গবেষক পুলক কুমার রায়ও।

অধ্যাপক ডঃ পি.কে. দাস 

 

আরও পড়ুন
বিশ্বের প্রথম ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় ৩৩ জনই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের

তবে লড়াইটা এখানেই শেষ নয়। আরও বড় এক সমস্যার সমাধান খুঁজতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ বাঙালি গবেষক। সুমন্তবাবুর কথায়, “হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন অনেক সময়ই সমস্যাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একই ব্লাডগ্রুপের হৃদপিণ্ড পাওয়া দুষ্কর। কাজেই একধরণের যন্ত্র রয়েছে যা হৃদপিণ্ডের এই পাম্পিংয়ের কাজ করে। সারা পৃথিবীতে মাত্র দুটি সংস্থা রয়েছে যারা এই যন্ত্র তৈরি করে। সারা ভারতে ১৫টি এমন প্রতিস্থাপন হয়েছে। এমন রোগী রয়েছেন কলকাতাতেও দিব্যি সুস্থভাবে। তবে এই যন্ত্র প্রতিস্থাপনে খরচ হয় প্রায় ১ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা কার্যত অসম্ভব। ভারতে একদম কম খরচে সেই যন্ত্র তৈরির কথাই রয়েছে আমার পরিকল্পনায়...”

হ্যাঁ, হৃদযন্ত্র সম্পূর্ণ কাজ বন্ধ হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন সুস্থভাবে সম্ভব হবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা। সাধারণের সাধ্যের মধ্যেই তেমন প্রযুক্তিগত পরিষেবা আসতে পারে সুমন্তবাবুর পরবর্তী গবেষণার হাত ধরে। আর তা বাস্তবায়িত হলে চিকিৎসার জগতে বিপ্লব খেলে যাবে অনায়াসেই। সেদিকেই লক্ষ্য স্থির রেখেছেন গবেষক সুমন্ত লাহা। এখনও চলার বাকি অনেকটা পথ... 

Powered by Froala Editor

More From Author See More