প্রাচীন পুঁথিতে লুকিয়ে গণিতের অজানা ইতিহাস, উত্তর খুঁজছেন বাঙালি গবেষক

“ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই গণিতের চর্চা ছিল। সারা বিশ্বের গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে ভারতের অবদানও প্রচুর। এসমস্ত কথা তো আমরা ছোটো থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু এই কথার পিছনে যথার্থতা কতটুকু? অবদান যে আছে, সেটা ঠিক কীরকম? এসব প্রশ্ন অনেকেই মনে মধ্যে আনেন না। আর সেই উত্তর খুঁজতেই আমি এখন দিনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিই।” 

বলছিলেন অংশুমান ভট্টাচার্য। তিনি গণিতজ্ঞও নন, ইতিহাসের গবেষকও নন। তাঁর কাজ একেবারেই কর্পোরেট জগতের কাজ। উইপ্রো, কগনিজেন্টের মতো বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করে অবশেষে কলকাতার বুকেই গড়ে তুলেছেন সিবিয়া অ্যানালিসিস নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। মুম্বাইতেও তৈরি হয়েছে একটি শাখা। কিন্তু পুরনো পুঁথির গন্ধ যেন এখন তাঁকে নেশার মতো টানে। আর সেই আকর্ষণেই ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে।

“প্রাচীন ভারতের গণিতচর্চার ইতিহাস নিয়ে কিন্তু একসময় বেশ ভালোভাবে কাজ শুরু হয়েছিল। কলকাতা, মাদ্রাজ, লক্ষ্ণৌ এবং পাটনা, এই চারটি শহরের আর্কাইভে বহু পুঁথি সংরক্ষণ করা আছে। কিছু আছে প্রিন্ট কম্পোজিট হিসাবে। সেইসব আর্কাইভ ঘেঁটে আমি মূল গ্রন্থটাকেই পড়তে চেষ্টা করি।” অংশুমানবাবুর কথায়, “ইকোনমিক্স নিয়ে পড়ার ফলে অঙ্কটা বুঝতে তো খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে সংস্কৃতটা বুঝতে সত্যিই সমস্যা হত প্রথম প্রথম। এখনও কিছুটা হয়। কিন্তু মূল গ্রন্থ না পড়ে তো একটা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।” তবে এই ইতিহাসের মধ্যে থেকে কি বিশেষ কিছু খুঁজে চলেছেন তিনি? না, ঠিক বিশেষ কিছু নয়। বহুক্ষণ আলাপচারিতার পর যেটা বোঝা গেল, তিনি আসলে ভারতের গণিতচর্চার ইতিহাসটাকেই ধরতে চান। কবে কীভাবে কোন সূত্রের জন্ম হয়েছে, কীভাবে সেই সূত্র পরবর্তী গণিতজ্ঞদের প্রভাবিত করেছে, কীভাবে বদলেছে সবটা, সমস্তটার একটা কালচিত্র তৈরি করাই তাঁর উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন
পরিবারের মধ্যেই গণিত নিয়ে রেষারেষি, বার্নৌলিদের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস

“তবে ভারতীয় গণিত বললেই সবাই বোঝেন ফলিত জ্যোতিষের কথা। সেটার দিকে কিন্তু আমার কোনো আগ্রহ নেই।” বলে ওঠেন অংশুমানবাবু। তারপর হেসে বলেন, “আসলে হয়তো ধর্মীয় কারণেই আর্যভট্ট, বরাহমিহির, প্রথম ভাস্করাচার্যের ফলিত জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। আর তার মধ্যে আড়ালেই থেকে গিয়েছে এদেশে বিশুদ্ধ গণিতের চর্চা।” একটু একটু করে তিনি বলছিলেন সেইসব ইতিহাসের কথাও। বলছিলেন, শুধু ভারতেই নয়, নানা দেশে কীভাবে বদলেছে গণিতের চর্চা। বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাতকে যেমন আমরা ‘পাই’ বলে চিহ্নিত করি, একসময় নাকি তার নানা নিকটবর্তী মান গ্রহণ করা হত পৃথিবীতে। আর ভারতে এই মান ধরা হত ১০-এর বর্গমূলের সমান। সত্যিই কি অদ্ভুত নৈকট্য দুটো সংখ্যার।

আরও পড়ুন
জার্মান কোড সমাধান করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে চার বছর কমিয়ে দেন এই গণিতবিদ

অংশুমানবাবু বলছিলেন, ত্রৈরাশিকের ব্যবহারও বিবর্তিত হয়েছে নানাভাবে। শুন্বসূত্র থেকে পরবর্তীকালের নানা গ্রন্থে তার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এই বিবর্তনের একটা রেখাচিত্র কেউ তৈরি করে যাননি। কিন্তু ইতিহাসকে বুঝতে গেলে সেই কাজটা জরুরি। এমনকি শ্রীধরাচার্যের বিখ্যাত বীজগাণিতিক সূত্রের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত হলেও তাঁর পাটিগণিত চর্চার খোঁজ তো আমরা সত্যিই রাখি না। অংশুমানবাবুর কথায়, “আমি পড়তে গিয়ে দেখেছি আজও ছোটোবেলায় যে পাটিগণিত আমাদের শেখানো হয়, তা সেই শ্রীধরাচার্যের বইয়ের পদ্ধতি মেনেই। শুধু তো গণিতচর্চা নয়, গণিতশিক্ষার রাস্তাও দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।” এমনকি শ্রীধরাচের্যের সেই পাটিগণিতের বইতেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন ডেরিভেটিভ বন্ডের সূত্রও। আজও যে সূত্র ব্যবহার করা হয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায়। নানা ধরনের ঋণের সামগ্রিক হিসাব করা হয় সেই সূত্র মেনেই।



আরও পড়ুন
ফর্মুলায় ভবিষ্যদ্বাণী করেই গণিতের ‘নোবেল’জয়ী মার্টিন হায়রার

“১৮৯০ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত ভারতীয় গণিতের ইতিহাস নিয়ে নানা চর্চা হয়েছে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ, জিডি জোসেফের মতো নানা গবেষক বিশ্লেষণ করছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাতে ইউরোপকেন্দ্রিকতার ছাপ পড়েছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক কাজ করে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ দত্ত, পিকে ব্যানার্জির মতো গবেষকরা। আমার সেই স্তরের কাজ করার মতো সময় বা যোগ্যতা কোনোটাই হয়তো নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভারতের গণিতচর্চার ইতিহাসে এখনও অনেক সূত্র আছে, যা বর্তমানে ব্যবহারিক বিজ্ঞানে কাজে লাগতে পারে।” এই আকর্ষণেই বারবার পুরনো পুঁথিতে মুখ গুঁজে দেন অংশুমানবাবু। তবে এই বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়া ইতিহাসের গবেষকরা এগিয়ে এলে কাজটা আরও অনেক সহজ হবে বলে মনে করছেন তিনি। কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু মহামারী করোনার ফলে সেই কাজ আর এগোয়নি। আশা করব, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবেন অংশুমান ভট্টাচার্য। আর এবার নিশ্চই গবেষণায় পাশে পাবেন অনেককেই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More