বিলুপ্তির পথে বাংলার গেঁড়ি-গুগলি, আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্সির দুই গবেষক

“গেঁড়ি এবং গুগলি, খাদ্যতালিকায় এই খাবারটি থাকলে উচ্চবিত্ত বাঙালির একটু নাকউঁচু মানসিকতাই প্রকাশ পায়। তবে আজও গ্রামাঞ্চলের বহু দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রোটিনের সবচেয়ে বড়ো উৎস এই প্রাণীই।” বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ সুমিত মণ্ডল। শুধু মানুষই নয়, এদেশের জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী এটি। হাঁস-মুরগির খাদ্য তো বটেই। ভারতের স্বাদুজলে পাওয়া খোলসযুক্ত প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যায় উপস্থিতি এদের। কিন্তু সম্প্রতি মানুষের হাতে পরিবেশ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে তাদের বিলুপ্ত হতে আর বেশি বাকি নেই। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ইকোলজি ল্যাবরেটরিতে বসেই গবেষণা করেছেন গবেষক শ্রীতমা বাগ এবং ডঃ সুমিত মণ্ডল।

চলতি বছরের শুরুতেই ‘জার্নাল অফ থার্মাল বায়োলজি’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্র। তাতে তাঁরা দেখিয়েছেন, কীভাবে উষ্ণায়নের প্রভাবে সঙ্কটে পড়েছে এই জলজ প্রাণী। দেখা গিয়েছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে তাদের আকার। আর আকার ছোটো হওয়ার ফলে অতি সহজেই অন্য প্রাণীর শিকারে পরিণত হচ্ছে তারা। সেইসঙ্গে পৌষ্টিকতন্ত্র থেকে রেচনতন্ত্র, সবেতেই প্রভাব ফেলছে উষ্ণায়ন। আর খাদ্যশৃঙ্খল থেকে একটি প্রাণী হারিয়ে যাওয়া মানে সামগ্রিকভাবেই বাস্ততন্ত্রের ক্ষতি। “সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, সামুদ্রিক জলের প্রাণীরা তো উষ্ণতা বৃদ্ধির সময় গভীর জলে চলে যেতে পারে। কিন্তু স্বাদু জলের জলাশয় তো খুব গভীর হয় না। ফলে প্রাণীরা তো খুব গভীরে যেতেও পারে না। গেঁড়ি-গুগলির খাবার পাওয়া যায় পুকুরের পাড়ের দিকেই। ফলে গভীর জলে গেলে তারা খাবারও পাবে না।” বলছিলেন ডঃ সুমিত মণ্ডল।

তবে শুধুই উষ্ণায়ন নয়, কৃষিপ্রধান বাংলায় আরও বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কীটনাশকের ব্যবহার। উষ্ণায়নের সঙ্গে কীটনাশকের মিলিত প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে এলসেভিয়ারের জার্নাল ‘কেমোস্ফিয়ার’-এ। বজবজের একটি পুকুর থেকে গেঁড়ি সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। সেই পুকুরে কীটনাশকের প্রভাব ছিল না। পরীক্ষাগারে তাদের উপরে উষ্ণতা ও কীটনাশকের মিলিত প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর তাতে দেখা যায়, শুধু শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া নয়, পরিবর্তন ঘটল প্রাণীদের ডিএনএ-তেও। তাছাড়া গেরি-গুগলিদের হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ, জলে অক্সিজেনের অভাব। এরা নোংরা জলে থাকতে পারে না। জলে খোলসযুক্ত প্রাণী থাকা মানে বুঝতে হবে, তার অবস্থা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এমন জলাশয়ও তো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে যে খুব অল্পদিনের মধ্যেই এই প্রাণীটি হারিয়ে যাবে, সেটাই প্রমাণ করলেন শ্রীতমা বাগ এবং ডঃ সুমিত মণ্ডল।

তবে সমাধান কি কিছুই নেই? “গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে। কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হবে। জৈব কৃষিকাজের উপর জোর দিতে হবে। এছাড়া চটজলদি কোনো সমাধান নেই।” বলছেন ডঃ সুমিত মণ্ডল। আর এর জন্য অ্যাকাডেমিক স্তরে যতই আলোচনা চলুক না কেন, আসল দায়িত্ব নিতে হবে সাধারণ মানুষকেই। ডঃ সুমিত মণ্ডলও চান, তাঁর গবেষণার কথা ছড়িয়ে পড়ুক সাধারণ মানুষের মধ্যে। যাঁরা নিজেদের খাদ্যের জন্য এই প্রাণীর উপর নির্ভরশীল, তাঁরাই আগে বুঝুক বিপদ কতটা আসন্ন।

Powered by Froala Editor