সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছে, মেক আপ রুমেও পিছু নিলেন চিন্ময় রায়

তখন তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় ‘বালিকা বধূ’ মুক্তি পেয়েছে। বাংলার দর্শক চিনল মৌসুমী চ্যাটার্জিকে। সেইসঙ্গে আরও একজন অভিনয় করেছিলেন সেই সিনেমায়। তিনি জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পরই ঘটল এক অদ্ভুত কাণ্ড। রোগা, প্যাংলা মতন একটা ছেলে দেখা করতে এল তাঁর সঙ্গে। এবং সটান বিয়ের প্রস্তাব! জুঁই তো অবাক। একদম সাদামাটা চেহারা, আবার অভিনয়ও করে। কিন্তু একেবারে বিয়ের প্রস্তাব। যুবক চিন্ময় রায় একগাল হেসে বললেন, প্রেমে পড়লে বেশিদিন ফেলে রাখতে নেই। টুক করে কথা বলে নিতে হয়! পরে অবশ্য দুজনেরই চার হাত এক হয়ে যায়…

বাঙালির চিরকালীন ডায়লগটা চিন্ময় রায় অবশ্য দিয়েই গেছেন ‘বসন্ত বিলাপ’-এ। পুকুর ঘাটে বসে সেই অমর উক্তি ‘একবার বলো উত্তমকুমার!’ সত্যিই তো, কে না উত্তম হতে চায়! কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া চিন্ময়ও চেয়েছিলেন অভিনয় জগতে ছাপ ফেলতে। কিন্তু তিনি তো তথাকথিত সুশ্রী নন! আর চেহারা? তা আর কহতব্য নহে। স্বয়ং সায়রা বানুও নাকি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন চেহারা দেখে। এতকিছুর পরোয়া করার বান্দাই ছিলেন না চিন্ময় রায়। ম্যাট্রিকে থার্ড ডিভিশনে পাশ করা রোগা ছেলেটি যে একটা সময় দিকপাল হয়ে উঠবে, কে জানত! 

চিন্ময় রায় মানেই নিখাদ মজা। তাঁর চলন, বলন, সংলাপ বলা— সব কিছুর মধ্যেই ফুটে ওঠে হাস্যরস। প্রথম সিনেমা ‘গল্প হলেও সত্যি’ই বলুন, বা ‘বসন্ত বিলাপ’, চিন্ময়ের ক্যারিশমাই ছিল আলাদা। কিন্তু শুধুই কি হাসিতেই থেমে থাকবেন তিনি? না, সেটা ইচ্ছাও ছিল না তাঁর। পর্দায় অভিনয়ের আগেও তাই হাজির হয়েছিলেন নাটকের মঞ্চে। দীর্ঘদিন নান্দীকারে অভিনয়ও করেছিলেন। এবং সেখান থেকেই বেড়ে উঠলেন অভিনেতা চিন্ময় রায়। যিনি কেবল হাস্যকৌতুক নয়, সমস্ত চরিত্রই নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। 

চিন্ময় রায়ের নাম এলেই চলে আসবে আরও একজনের কথা। পটলডাঙার রোয়াকে বসে আড্ডা মারেন তিনি, প্যালা-হাবুল-ক্যাবলাকে গাট্টা মারেন, আর এক কামড়ে একটা পাঁঠা হজম করেন। হ্যাঁ, কলকাতার সেই বীর টেনিদা। তাঁকেই জীবন্ত করে তুলেছিলেন চিন্ময় রায়। টেনিদার মতো নিজেও যে ভোজনরসিক! অমন চেহারা হলে কী হবে! একবার একটি অনুষ্ঠানে গেছেন চিন্ময়। সঙ্গে গেছেন অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ; এবার উদ্যোক্তারা সন্ধ্যা রায়ের হাতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি তুলে দিয়েছেন। সেটা গাড়িতেও তোলা হল। বাড়ি ফিরে দেখলেন, হাঁড়ি হাওয়া! এটা কেমন হল? এই তো চোখের সামনে মিষ্টির হাঁড়িটা রাখা হল! কয়েকদিন পর চিন্ময় রায়ের টেলিফোন— মিষ্টিটা বেশ ভালোই ছিল। সন্ধ্যা রায় অবাক! তাহলে চিন্ময়ই এক হাঁড়ি মিষ্টি সাবাড় করল! 

চেহারাতেই রোগাটে, মনে সাহস ছিল অফুরন্ত। একদিন সোজা চলে গেলেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আলাপ করতে। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছেন, শুটিংয়ের জায়গায় ধুঁকছেন মহানায়িকা। সামনে থেকে দেখলে যেন আরও মোহময়ী। ব্যস, আলাপ করতেই হবে! এদিকে সুচিত্রা সেনের কাছেও কেউ যাচ্ছেন না তখন। কাজে নিজেই পিছু নিলেন চিন্ময়। সুচিত্রা সেন দেখলেন; কিছু বললেন না। কিন্তু এই ছেলে যে মেকআপ রুম অবধিও চলে এল! বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুচিত্রা - কী চাই? ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করতে’। রেগে গেলেন মহানায়িকা। সোজা মেকআপ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর, দরজা খুলে ঢুকতে বললেন চিন্ময় রায়কে। শেষপর্যন্ত যেন স্বপ্ন সার্থক হল চিন্ময় রায়ের। তিনি তো অভিনেতা হতেই চেয়েছিলেন। বাংলা সিনেমা কি তাঁকে ভুলতে পারে? পর্দার ‘টেনিদা’ যে অমর! 

তথ্যসূত্র-
১) ‘ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন চিন্ময়’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘বসন্তের বিলাপে বাঙালিকে রেখে জীবনাবসান চিন্ময় রায়ের, একনজরে তাঁর জীবনসফর’, শ্রীতমা মিত্র, ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা
৩) মীরাক্কেল ভিডিও, ফেসবুক 

আরও পড়ুন
প্রমথেশ বড়ুয়াই প্রকৃত ‘দেবদাস’, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উত্তমকুমার

Powered by Froala Editor

More From Author See More