ছুটির দিনে কফি হাউসে বসেই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ষাটের দশকের কলকাতা। রবিবারের সূর্যের আলো পড়েছে কফি হাউসের টেবিলের ওপর। একটু একটু করে ভিড় বাড়বে এবার। কর্মীরাও প্রস্তুত হচ্ছেন। চায়ের কাপে তুফান তুলে আসবে কবিতা, সাহিত্য, বিতর্ক। সকাল সকাল যারা এসেছেন, তাঁদের চোখ চলে যাচ্ছে একটি বিশেষ দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকের কোণায়, একটি টেবিল দখল করে বসে আছেন কয়েকজন যুবক। হাতে কাগজপত্র, নতুন কবিতার পাণ্ডুলিপি। ওঁদেরই একজনকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন কফি হাউসের বাকিরা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chattopadhyay) না?

ততদিনে ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেয়ে গেছে। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে দেখছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ও। সেই সূত্রেই জায়গা করে নিলেন সৌমিত্র। ধীরে ধীরে খ্যাতির শিখরে পৌঁছবেন তিনি। উত্তম কুমারের পর অবিসংবাদী নায়ক-অভিনেতা হিসেবে ইতিহাসে জায়গা পাবেন। হয়ে উঠবেন কিংবদন্তি। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের ‘স্টারডম’কে কখনও প্রকাশ করেননি সৌমিত্র। কখনও বাড়তি লাইমলাইট নেওয়ার অভিপ্রায়ও ছিল না। অভিনয়, নাটক ছাড়াও তাঁর জীবনে আরও একটি প্রেম শুরু থেকেই বিকশিত হয়েছিল- কবিতা, সাহিত্য, এবং ‘এক্ষণ’ পত্রিকা। যে পরশ রয়ে গিয়েছিল শেষ দিন পর্যন্ত। 

বাংলার পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের আঁতুড়ঘর, গোলটেবিল বৈঠকের জায়গা কফি হাউস। সৌমিত্রও সেই টান অনুভব করতেন সবসময়। কলেজ জীবন থেকেই অভিনয় করা টুকটাক; তখন তাঁর সঙ্গে একই কলেজে এক ক্লাস ওপরে পড়তেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। সেখানে দুজনেই একটি নাটকে অভিনয় করেন, ছাত্র রাজনীতিও করেন। অবশ্য গভীর ঘনিষ্ঠতার অনুঘটক ছিল কবিতা। সুনীলের পাশাপাশি তখন পরিচয় হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। অভিনয়ের আগে সাহিত্য জগতের সঙ্গেই আলাপ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। একটু আধটু কবিতা চর্চা, লেখালেখি। তাঁদের দলের মধ্যেই ছিলেন গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে এই ‘গৌরদা’ই একসূত্রে জুড়েছেন সাহিত্য এবং নাটককে। গৌরমোহনের মাধ্যমেই যোগাযোগ শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে। সেই সূত্রেই কফি হাউসেও ঘন ঘন যাতায়াত। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কখনও চলছে লেখা নিয়ে আলোচনা, কখনও পত্রিকা আদানপ্রদান। 

সেই সময়ই কফি হাউসের একটি বিশেষ জায়গার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘হাউজ অফ লর্ডস’। কে না বসতেন সেখানে। কমলকুমার মজুমদার, সত্যজিৎ রায়-সহ আরও বহু নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা। তখনও সত্যজিৎ পথের পাঁচালি করেননি; সুকুমার রায়ের সুযোগ্য পুত্র এবং একজন প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। কমলকুমারকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছে একটা মিথ। তৈরি হচ্ছেন সুনীল, শক্তি, শরৎকুমারের মতো লেখক-কবিরা। কফি হাউজের ‘হাউজ অফ লর্ডস’ তখন জমজমাট। সেখানেই মাঝে মধ্যে ঢুঁ মারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখনই আলাপ কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে। 

অশীতিপর গদ্যকার সুবিমল বসাকের স্মৃতিচারণাতেও উঠে এল সেই সময়ের কথা। “রবিবার করে কফি হাউসে আসতেন সৌমিত্র। পরনে সাধারণ হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবী। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বসে পত্রিকার কাজ করতেন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক বন্ধুরাও যোগ দিতেন ওই দলে। একবার দুপুরের দিকে দেখেছিলাম করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে; যিনি পথের পাঁচালিতে ‘সর্বজয়া’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। রবিবার ছাড়াও ছুটির দিনগুলোতে সময় পেলেই চলে আসতেন কফি হাউসে।” 

কবিতা, আবৃত্তি— এসব নিয়েই কেটে যেত সৌমিত্রের জীবন। তখন সিনেমায় অভিনয় করা শুরু করে দিয়েছেন তিনি। বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিতি পাচ্ছেন। তবুও নিজের ‘রুটিন’ বদলাননি। শুটিংয়ের মধ্যে যখনই ছুটি পেতেন, চলে আসতেন কফি হাউস। বিশেষ করে রবিবারগুলো। ১৯৬১ সাল। সিটি কলেজের সহপাঠী নির্মাল্য আচার্য এবং আরও অনেকের সঙ্গে কফি হাউসে আড্ডায় মেতেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হঠাৎই নির্মাল্য ঠিক করলেন একটি পত্রিকা বার করবেন। বাংলা পত্রিকা, বাঙালির পত্রিকা, কবিতার পত্রিকা। শর্ত একটাই - সৌমিত্রকে থাকতে হবে। টালবাহানার পর রাজি হলেন সৌমিত্রও। সেই বছরেই পথ চলা শুরু হল ‘এক্ষণ’-এর। প্রকাশের আগে সবাই গেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। পত্রিকার নামকরণ করে দেন তিনি। তারপর এপ্রিল মাসে কফি হাউসে বসেই শুরু হল পত্রিকার যাত্রা। আর রবিবার সকালে সেখানে বসেই সম্পাদনার কাজ করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন তিনি অভিনেতা নন, পত্রিকার একজন সম্পাদক। একজন কবি। যারাই এসেছেন সেই সময়, অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছেন ওঁর দিকে। সৌমিত্র’র অবশ্য কোনদিকে মন ছিল না। টেবিলের ওপর জমা রয়েছে কাগজের স্তূপ। সেইসঙ্গে নিজেও লিখতেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্যও ছোটাছুটি করতেন। 

আরও পড়ুন
হিন্দি ও ফরাসি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র, হাত পাকিয়েছেন পরিচালনায়

বাংলা সাহিত্য জগতে ‘এক্ষণ’-এর ভূমিকাটা ঠিক কী বা কতটা, সেটা আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং নির্মাল্য আচার্যের যুগ্ম সম্পাদনায় এক্ষণ একটা নতুন দিক ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেই সময় বাংলা ভাষার এমন কোনো বড়ো লেখক ছিলেন না যিনি ‘এক্ষণ’-এ লেখেননি। এইভাবেই এক নতুন ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়েছিলেন সৌমিত্র। পরবর্তীতে একটি সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন, “বম্বেতে গেলে আমি কি এক্ষণ বার করতে পারতাম?” পরের দিকে অভিনয়ের ব্যস্ততার জন্য সেভাবে জড়িত থাকতে পারেননি সম্পাদনার কাজে। কিন্তু এক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছিল সারাটা জীবন। অদ্ভুত নেশা ছিল যে! টেবিল টেবিলে চলত এক অদ্ভুত যাপন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথাতেই নিজের কবিতার বই বার করলেন সৌমিত্র। তখন তিনি অভিনেতা নন, দর্শকদের একান্ত আপন ‘ফেলুদা’ বা ‘অপু’ নন; তিনি কেবলই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের গুণগ্রাহী সাধক; যার মঞ্চ ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকের বাড়িটি… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘অকপটে সৌমিত্র’, সাক্ষাৎকার, সুমন দে, এবিপি আনন্দ
২) ‘ফিরে আসুন তিনি’, পবিত্র সরকার, যুগান্তর
৩) ‘আমাদের মনের মিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’, উৎপল দত্ত, রাইজিং বিডি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র

More From Author See More