হিন্দি ও ফরাসি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র, হাত পাকিয়েছেন পরিচালনায়

১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাস। বাংলার অন্যান্য জায়গার মতো ধান্যকুড়িয়া গ্রামেও শীত পড়েছে। কিন্তু কেউই প্রায় জবুথুবু হয়ে বসে নেই। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। কী এমন ঘটল গ্রামে? একটু পরেই বোঝা গেল আসল ঘটনা। ওই যে দেখা যাচ্ছে শুটিংয়ের দল। একটি সিনেমার জন্য তারকাদের ভিড় জমেছে গ্রামে। তাও যে সে সিনেমা নয়; ফরাসি সিনেমা। শাবানা আজমি, সুপ্রিয়া ঘটকদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন ব্রিটিশ অভিনেতা হিউ গ্রান্টও। আর তাঁদের মাঝে… ওই যে ফেলুদা! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে চিনতে এতটুকুও দেরি করেনি ধান্যকুড়িয়া… 

সত্যজিতের পরিচালিত ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সেইসঙ্গে অন্যান্য বাংলা ছবি তো আছেই। একটা বিশাল ক্যানভাসে বিচরণ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যার পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল বাংলা। আর তার বাইরে? তখনও তিনি পাননি ‘লিজিয় দ্য অঁর’। প্রথম ভারতীয় সিনে ব্যক্তিত্ব হিসেবে ‘অর্ডার অফ আর্ট অ্যান্ড লেটারস’ অর্জনের তখনও দশ বছর বাকি। তার আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফ্রান্সের যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। আর সেই মাধ্যমটি ছিল সিনেমা…

মির্চা এলিয়াদের লেখা ‘লা নুই বেঙ্গলি’ বইটি আমাদের সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত। সেখান থেকেই ফরাসি পরিচালক নিকোলাস ক্লটস তৈরি করলেন নিজের পরবর্তী সিনেমার চিত্রনাট্য। সিনেমার নাম ‘দ্য বেঙ্গলি নাইট’। তিরিশের দশকের এক বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে এক বাঙালি তরুণীর প্রেমের গল্প। মূল নায়ক অ্যালানের ভূমিকায় এলেন অভিনেতা হিউ গ্রান্ট। নিকোলাস ঠিক করলেন, অন্যান্য চরিত্রে ভারতীয় অভিনেতাদেরই নেবেন। সেই সূত্রেই যুক্ত হলেন শাবানা আজমি, সুপ্রিয়া পাঠক। যুক্ত হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। ১১৫ মিনিট দীর্ঘ ছবিটির কিছু অংশ শুট হয়েছিল ধান্যকুড়িয়া গ্রামে। সেই অভিজ্ঞতা এখনও যেন লেগে আছে সেখানে। সেইসঙ্গে কলকাতা তো ছিলই। ‘দ্য বেঙ্গলি নাইট’ সিনেমাটি অবশ্য খুব বেশি চর্চিত হয়নি। ১৯৮৯ সালে ভারতে একটি ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছিল; ওই একবারই। 


আরও পড়ুন
প্রস্তাব ফেরালেন উত্তমকুমার, সেই চরিত্র লুফে নিয়েই বাজিমাত সৌমিত্রের

এরপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ফরাসি সরকারের তরফ থেকে সম্মানও পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফিল্মফেয়ার, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার— সম্মানের ঝুলি উপচে পড়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও বলিউডের ময়দানে সেভাবে প্রায় দেখাই গেল না সৌমিত্রকে। বাংলার প্রতি ভালোবাসা, সিনেমা, নাটক এবং সাহিত্য জগত নিয়েই তিনি মেতেছিলেন। একেবারেই কি আসেননি হিন্দি সিনেমার জগতে? সেইভাবে দেখলে, দুটি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালে বিজয় চ্যাটার্জির ‘নিরুপমা’ এবং ২০০২ সালে প্রশান্ত বলের ‘হিন্দুস্তানি সিপাহী’। এই দুটি সিনেমার সঙ্গেও যুক্ত ছিল বাংলা আখ্যান। ‘নিরুপমা’ ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা পাওনা’র হিন্দি চিত্রনাট্য। আর সেই সিনেমাতেই অভিষেক হয়েছিল অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের। আর ‘হিন্দুস্তানি সিপাহী’র চিত্রনাট্য করা হয়েছিল উৎপল দত্তের ‘ফেরারি ফৌজ’ অবলম্বনে। আর ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন আরেক অভিনেতা, ভিক্টর ব্যানার্জি। 

আরও পড়ুন
‘সোনার কেল্লা’ নয়, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ই ছিল সৌমিত্রের প্রিয় ফেলু-সিনেমা

উল্লেখ্য, পরিচালনার দিকে সেভাবে না এলেও, জীবনে একটিমাত্র সিনেমা নিজে পরিচালনা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এখানেও তাঁর ভরসা সেই রবীন্দ্রনাথ। ‘স্ত্রীর পত্র’ অবলম্বনে ১৯৮৬ সালে তৈরি করলেন নিজের পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘স্ত্রী কা পত্র’। ‘নিরুপমা’য় কাজ করার সুবাদে আলাপ হয়েছিল নবাগতা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই ছবিতে ‘মৃণাল’-এর ভূমিকা দিলেন তাঁকে। সঙ্গে ছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় এবং স্বয়ং সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী বোস (চট্টোপাধ্যায়)। তাঁর সিনে মানচিত্রে খুব একটা উঁচু জায়গায় হয়তো থাকবে না এই ছবিগুলো। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজের সামগ্রিকতাকে ধরতে গেলে, এই ছবিগুলোকে অস্বীকার করা যাবে কি? সব জায়গাতেই যে তিনি সাবলীল!

চিত্রঋণ - গেটি ইমেজ

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More