উত্তমের নায়িকা থেকে গুরু দত্তের ‘প্যায়াসা’, অদম্য জেদেই বলিউড-জয় ‘নেপালি’ মালার

তিরিশের দশক। নেপাল থেকে ততদিনে কলকাতায় চলে এসেছেন অ্যালবার্ট সিনহা। জাতিতে নেপালি, ধর্মে যিশুর উপাসক। সেই ঘরেই জন্ম নিল ফুটফুটে একটি মেয়ে; আলডা। একটা সময় স্কুলেও যেতে শুরু করল সে। তারপরেই বাধল বিপদ। আর কিছুই নয়, ছোট্ট আলডা কিছুতেই স্কুলে যেতে রাজি নয়। কেন? বন্ধুরা তাঁর নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করে খুব। সবাই বলে ‘ডালডা’। ছোট্ট মেয়েটির অভিমান হওয়াই স্বাভাবিক। বেশিদিন তো এমনটা চলতে পারে না। একদিন সেই মেয়েই ঠিক করল- নিজের নামটাই বদলে দেবে। ‘আলডা সিনহা’র গুটি কেটে জন্ম নিল নতুন এক নাম- ‘মালা সিনহা’…

অবশ্য নাম বদলের পালা এখানেই থেমে যায়নি। ছোটো থেকেই নাচ-গানে পারদর্শী মেয়ে একসময় পা রাখল আকাশবাণীর দফতরে। তখন অবশ্য তিনি মালা সিনহা নন। ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে আরও একটি নাম, বেবি নাজমা। এই নামেই বেশ কিছু জায়গায় অভিনয়ও করেন মালা। আর তারপর, বড়ো হয়ে ‘নাজমা’ হয়ে যায় ‘মালা’। ততদিনে ছোটো নদী পরিণত হয়েছে বড়ো নদীতে। কিন্তু উত্তরণের যাত্রাটি কি এত সহজ ছিল? 

মালা সিনহা বললেই আমাদের সামনে চলে আসে উজ্জ্বল, বড়ো দুটি চোখ, টানা টানা কাজল, আর ঠোঁটের নিচে ডানদিকে একটি তিল। নেপালি হলেও জন্ম যে কলকাতায়! নিখাদ বাঙালি; সেই সূত্রে ‘বেবি নাজমা’ হয়েই বাংলা সিনেমার জগতে পা রেখেছিলেন তিনি। তবে নায়িকা হওয়া আরও পরে, সেটাও বাংলা ছবির হাত ধরেই। একদিন স্কুলের একটি নাটকের অনুষ্ঠানে হাজির হন পরিচালক অর্ধেন্দু বসু। সেখানেই চোখ পড়ে বছর ষোলো’র মালা সিনহাকে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরবর্তী ছবির নায়িকা হিসেবে তাঁকে বেছে নিলেন। এই মেয়ের শুধু রূপই আছে তা নয়, অভিনয়টাও জানে। প্রথমে অবশ্য রাজি ছিলেন না অ্যালবার্ট সিনহা। পরে সেই বিধিনিষেধ কেটে গেলে বড়োপর্দায় অভিষেক হয় মালার। 

প্রায় একই সময় মুম্বইতেও এক বাঙালির হাত ধরেই শুরু হয় তাঁর সিনেযাত্রা। ১৯৫৪ সালে পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর হাত ধরে মুক্তি পায় ‘বাদশাহ’। উল্টোদিকে নায়ক প্রদীপ কুমার। কিন্তু সিনেমা হিট করল না। অমিয়বাবু রীতিমতো ভেঙে পড়লেন। কথা ছিল, তাঁর আরও দুটি ছবিতে নায়িকা হিসেবে থাকবেন মালা সিনহা। ‘বাদশাহ’-এর পর সেই কন্ট্র্যাক্টও বাতিল করে দেন পরিচালক। প্রায় একই সময় আরও বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন মালা। কিন্তু একটাও সেরকমভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি। প্রযোজকদের কাছ থেকে কথা শুনতে হচ্ছে। ‘আয়নায় দেখেছ নিজের চেহারা?’ ছোটোবেলায় নিজের নাম নিয়ে, এখন চেহারা নিয়েও ব্যঙ্গ সইতে হচ্ছে তাঁকে। তাহলে কি এখানেই ইতি? দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন মালা সিনহা। বারবার লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালাবেন না তিনি… 

ঝড় তো সারাজীবন থাকে না। মেঘের আড়ালে যে লুকিয়ে আছে সূর্য। ১৯৫৭ সাল। মুম্বইয়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছেন বিখ্যাত পরিচালক শশধর মুখার্জি। হাজির হয়েছেন গুরু দত্তও। নির্দিষ্ট দিনে নাটক প্রদর্শিত হবে সেখানে। সেবার সেই নাটকে গীতা দত্তের হাত ধরে হাজির হলেন তরুণী মালা সিনহা। কেউ চেনে না তাঁকে। সামনে এত বড়ো বড়ো কুশীলবরা বসে আছেন। স্বয়ং গীতা দত্ত তাঁর ওপর ভরসা করেছেন। চোখ বন্ধ করে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলেন মালা। তাঁর অভিনয় দেখে চমকে গেলেন গুরু দত্ত। এই মেয়ে এখনও কেন জায়গা পেল না বলিউডে? সামনেই নিজের পরবর্তী ছবির কাজ শুরু হবে। গুরু দত্ত ডেকে নিলেন মালা সিনহাকে। আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। মুক্তি পেল ‘প্যায়াসা’। প্রথমে ঠিক ছিল, ‘মীনা’র চরিত্রে অভিনয় করবেন স্বয়ং মধুবালা। কিন্তু মালার অভিনয় দেখে গুরু দত্ত তাঁকেই নিলেন সেই ছবিতে। বাকিটা তো ইতিহাস! এই সিনেমা শুধু বলিউডেই নয়; মালা সিনহার জীবনেও নিয়ে এল পরিবর্তন। 

মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত ‘আলিগড়’ সিনেমাটির কথা মনে পড়ে? নিজের ঘরে একা, নিঃসঙ্গ প্রফেসর, টেবিলে রাখা মদের গ্লাসটা একবারই মাত্র হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। আর গোটা ঘর জুড়ে বাজছে একটাই গান- ‘আপ কি নজরোঁ মে সমঝা’। সিনেমাটির অন্যতম আইকনিক বলা হয় এটিকে। আর লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে বেজে ওঠা গানটির চলচ্চিত্রায়ণে দাঁড়িয়ে থাকেন মালা সিনহা-ই। মনে পড়বে ১৯৬২-র ‘অনপড়’ সিনেমাটির কথা। তার আগে থেকেই নিজের বিজয়পতাকা উড়িয়ে এসেছেন মালা। যে প্রযোজকরা একদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারাই এখন তাঁকে পেতে চায় নায়িকা হিসেবে। ১৯৫৮-এ ‘ফির সুভা হোগি’, ১৯৫৯-এ ‘দুধ কা ফুল’ সিনেমা দুটি তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিল একজন অভিনেত্রী-নায়িকা হিসেবে… 

আরও পড়ুন
মোটা টাকার চাকরি ছেড়ে টালিগঞ্জে, প্রথম অভিনয়েই চমকে দিলেন ছবি বিশ্বাসকে

পঞ্চাশের দশকের শেষদিক থেকেই বলিউডের সিনেমায় নারীবাদী হাওয়া উঠতে শুরু করে। যেখানে নায়কের পাশাপাশি প্রধান চরিত্র হিসেবে উঠে আসেন মেয়েরাও। আর সেই বদলের অন্যতম শরিক হলেন মালা সিনহা। কেবল নায়িকা হিসেবে নয়, অভিনয় ক্ষমতার জেরে সমালোচকদেরও নজর কেড়েছিলেন তিনি। আর সবটাই অর্জন করেছিলেন নিজের অধ্যাবসায়ের জোরে। যখন মুম্বাইতে পা দিয়েছিলেন, তখন একবর্ণও হিন্দি জানতেন না। নিজের চেষ্টায় সেই ভাষাটিকেও রপ্ত করেছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের অন্যতম প্রধান ও পরিচিত মুখ। তবে আক্ষেপ, অভিনয়ের এই সমুদ্রে সামনেই এল না গায়িকা মালা সিনহার নাম। একটা সময় আকাশবাণীতেও অংশ নিয়েছিলেন গানে। কিন্তু পরে ১৯৭২-এর ‘লালকর’ সিনেমা বাদে আর কোথাও গাইতে শোনা যায়নি তাঁকে। হয়তো বাড়ির ভেতরেই গুনগুন করে ওঠেন আজও… 

মুম্বইয়ের এমন উঠতি সময়ও কলকাতাকে ছেড়ে যাননি মালা সিনহা। সমান তালে বাংলা সিনেমাও করেছেন জীবনে। উত্তমকুমারের সঙ্গে করেছেন ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘বন্ধু’, ‘লৌহকপাট’, ‘সাথীহারা’র মতো ছবি। বাংলার দর্শক অবশ্য খুব বেশি ছবিতে পায়নি এই জুটিকে। তবে গীতা দত্তের সুরে, মালা সিনহার লিপে ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’ তো অমরত্ব পেয়ে গেছে সিনেমার জগতে। আর নেপালে যার আসল শিকড়, তিনি সেখানে অভিনয় করবেন না তা কি হয়? ১৯৬৬ সালে ‘মাইতিঘর’ই ছিল মালা সিনহার এক ও একমাত্র নেপালি ছবি। আর সেই সূত্রেই আলাপ চিদম্বর প্রসাদ লোহানি’র সঙ্গে। পরে এঁর সঙ্গেই চার হাত এক করেন মালা। 

মুম্বইয়ে, নিজের বাড়িতে আজ ৮৪ বছরে পা দেবেন মালা সিনহা। সিনেমা, লাইমলাইট এই সবকিছু থেকে অনেক দূরে এখন তিনি। জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন, ফিল্মফেয়ারের লাইফটাইম সম্মানও পেয়েছেন। এখন খানিক দূর থেকেই সিনে জগতকে দেখছেন মালা। চলছে নিজের সঙ্গে নিজের যাপন… 

আরও পড়ুন
গুগলের ডুডলে ভারতীয় নৃত্যশিল্পীর মুখ, অভিনয়েও জিতেছেন অজস্র মানুষের মন

তথ্যসূত্র-
১) ‘The road to stardom was bumpy- Mala Sinha opens up about her journey’, Farhana Farook, Filmfare
২) ‘জানতেন না হিন্দি, চেহারা নিয়ে প্রযোজকদের কটূক্তির জবাব নায়িকা হয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুদের ‘ডালডা’’, আনন্দবাজার পত্রিকা 

Powered by Froala Editor

More From Author See More