রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় ইরফানের, যে বাঙালির কাছে আজও কৃতজ্ঞ জাপানিরা

কাজের সূত্রেই হোক, বা স্রেফ ভ্রমণের জন্য - জাপানে পা পড়েছে অনেকেরই। জাপান মানেই অনেক ইতিহাস, অনেক মিথ। জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ঘুরতে ঘুরতে চলে আসা টোকিওর ইয়াসাকুনি শ্রিনে। বিশ্বযুদ্ধের ওই টালমাটাল সময় জুড়ে জাপানে যারা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে মেমোরিয়াল তৈরি হয়েছে ওখানে। হঠাৎ নজরে আসবে একটি ছোট্ট স্মৃতিফলক। একটি পাথরের বেদি; তাতে একজন মানুষের ছবি, পাশে আর নিচে জাপানি ভাষায় কিছু লেখা। মানুষটিকে দেখে ভারতীয় মনে হবে। বাস্তবিকই তাই; শুধু ভারতীয় নন, একেবারে খাস বাঙালি! পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর পেশা ছিল বিচারপতির। কিন্তু সুদূর জাপানে এক বাঙালি বিচারপতি স্মৃতিফলক কেন? এর পিছনে আছে বিশ্বযুদ্ধের পরের এক রোমাঞ্চকর ট্রায়ালের গল্প। যেখানে জুড়ে আছে বিশ্বের তাবড় দেশ, জুড়ে আছে জাপান। সঙ্গে এই বাঙালি উকিল, এবং— ইরফান খান!

দু-বছর পেরিয়েও অভিনেতা ইরফান খানের অকালমৃত্যুর রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারত। নান গল্প, স্মৃতিচারণে উঠে এসেছেন তিনি বারবার। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? এই ব্যাপারে আসার আগে একটু নজরে আনা যাক ওই বাঙালি উকিল ও একটি বিশেষ ট্রায়ালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে আগেই থেমে গিয়েছিল; পূর্বে জাপান তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর এল ১৯৪৫ সাল, আমেরিকা তৈরি করল দুটো পরমাণু বোমা। ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’-এর আঘাতে শ্মশান হয়ে যায় দুটো শহর। তারপরেই জাপানের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণে যুদ্ধের ইতি…

শেষ হইয়েও হইল না শেষ। তৎকালীন জাপান সরকারের ২৮ জন মন্ত্রী ও আধিকারিককে যুদ্ধবন্দি করা হল। তারপর শুরু হল লম্বা একটি ঐতিহাসিক বিচারপ্রক্রিয়া— দ্য টোকিও ট্রায়াল। বিশ্বের ১১টি দেশ থেকে স্বনামধন্য বিচারকদের মিলিত বেঞ্চ টানা দুই বছর ধরে বিচার করেন। এই ১১ জন বিচারকদের মধ্যেই ছিলেন ভারতের রাধাবিনোদ পাল। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত বিচারক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য। লেখার শুরুতে জাপানে যে বাঙালি বিচারকের স্মৃতিফলকের কথা বলা হচ্ছিল, রাধাবিনোদ হচ্ছে সেই ব্যক্তি।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের মাথায়। রাধাবিনোদ পাল তো জাপানের যুদ্ধাপরাধী নেতা-মন্ত্রীদের বিচার করতেই গিয়েছিলেন। তাহলে জাপানে তাঁকেই আলাদা করে এত সম্মান দেওয়া হল কেন? বাকিদের তো দেওয়া হল না! এখানেই আসে টোকিও ট্রায়ালের রোমাঞ্চকর দিকটি। বিচারক পাল আসার পরেই মতের বিরোধ শুরু হয় বিচারকদের মধ্যে। কারণ, তিনি প্রথমেই নৈতিকতার প্রশ্নটি তুললেন। কাকে যুদ্ধাপরাধী বলব? কাকে বলব না? ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে যুদ্ধাপরাধের শুরু? যদি জাপানের এই মন্ত্রীদের অপরাধী বলা হয়, তাহলে আমেরিকার প্রশাসনকেও অপরাধী বলতে হবে পরমাণু বোমা ফেলার জন্য। বাকিরা কঠিন শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে একপ্রকার বদ্ধপরিকর ছিলেন। রাধাবিনোদের এই যুক্তি তাঁদের আরও চিন্তায় ফেলে দিল। গোটা পাশ্চাত্য বিশ্বের সামনে রুখে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিল জাপান। তাঁরাই ছিল স্বাধীন। এটাই কি বাকিদের অস্বস্তি দিচ্ছিল?

সেই বিচারে অনেকের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, বেশ কয়েকজনের যাবজ্জীবনও দেওয়া হয়। কিন্তু রাধাবিনোদ পাল তাঁর নৈতিক বিচারের জন্য স্মরণীয় থেকে যান। তাঁর সাহস, সত্যিটাকে সামনে আনার স্পর্ধা অবাক করে বাকিদের। পরে তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের ল কমিশনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর এই সাহসের জন্য জাপানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিফলক…

এ তো গেল রাধাবিনোদ পালের প্রসঙ্গ। এখানে ইরফান খান কীভাবে এলেন? এখানে চোখ ফেরাতে হবে নেটফ্লিক্সের একটি সিরিজের দিকে। ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘টোকিও ট্রায়াল’। যার মূল প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ অবধি চলা এই বিখ্যাত বিচারসভা। সেখানেই রাধাবিনোদ পালের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান। অনবদ্য ছিল সেই অভিনয়। চোখের ভাষা, রাধাবিনোদের সেই অপ্রতিরোধ্য মনোভাব— একজন বর্ষীয়ান বাঙালি বিচারককে যেন রক্তমাংসের করে তুলেছিলেন তিনি। নিজেই বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন ইরফান। রাধাবিনোদের সাহস, সততা, যুক্তি ফোটানোর জন্য তাঁর থেকে ভালো কেউ বোধহয় ছিলেন না।

টোকিও ট্রায়াল পরবর্তীতে এমি নমিনেশনও পেয়েছিল। সেই ট্রায়ালও থেমেছে; ইরফান খানও অনেকদিন হল অন্য গাড়ি ধরে চলে গেছেন অন্য সিনেমায়। পৃথিবীর পাট চুকিয়ে সেই সব পেয়েছির দেশে হয়ত দেখাও হয়েছে বাস্তব ও পর্দার রাধাবিনোদের। কে জানে...

Powered by Froala Editor