দুর্গাপুজোর পদ্ধতি নিয়ে শাক্ত-বৈষ্ণবে বিবাদ, সমাধান মিলল সিংহে

বারোয়ারি দুর্গাপুজো হবে, আর তাতে ঝামেলা বাঁধবে না, তা কি হয়? তেমন ঘটনা একটা ঘটেই গেল একবার চুঁচুড়ায়। ১৮২৫ নাগাদ প্রাণকৃষ্ণ হালদার নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো দিয়ে চুঁচুড়ায় দুর্গাপুজো শুরু করেন। ‘তাহার শৃঙ্খলা ও ব্যয় দেখিয়া সকলেরই চমৎকার বোধ হইয়াছে।’

সেই ব্যয় দেখে নিন্দুকরা বললে,
‘দুর্গাপুজো ঘণ্টা নেড়ে, খোকা হলে বাজে ঢাক’
কাকাতুয়া ছেড়ে দিয়ে খাঁচায় পুরলে কি না কাক।।’

কিন্তু পরের বছর থেকে যখন বারোয়ারি পুজো শুরু হল, তখন দেবীকে শাক্ত না বৈষ্ণব— কোন পদ্ধতিতে পুজো করা হবে, তা নিয়ে গোল শুরু হল। শেষে পণ্ডিতরা বললেন একই মূর্তিকে একবার বৈষ্ণব আর একবার শাক্ত মতে পুজো করতে হবে। তাই সই। কিন্তু আবার ঝামেলা শুরু হল বিসর্জনের সময়। বৈষ্ণবরা বললে তাঁরা তো ঘট বিসর্জন দিয়েই দিয়েছে; আবার প্রতিমা বিসর্জনের খরচ তাঁরা দেবে কেন? ‘এই বিষয়ে দুই দলের দাঙ্গা উপস্থিত হইল।’ 

পরের বছর থেকে শাক্ত আর বৈষ্ণবদের মূর্তি আলাদা হয়ে গেল। ‘শাক্তের সিংহ সাধারণ আর বৈষ্ণবের সিংহ ঘোড়ামুখো হইত।’

আরও পড়ুন
‘গড সেভ দ্য কিং’ গান দিয়ে শুরু দুর্গাপুজো, খাবারের আয়োজনে ক্যাটারার!

কলকাতায় ব্রিটিশ শাসন কায়েমের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অনুগ্রহপুষ্ট দেশি বাবুসমাজের পক্ষে দুর্গাপূজার মতো অনুষ্ঠানের অজুহাতে সাহেবকুলকে নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের পানভোজন ও নৃত্যবিনোদনে আপ্যায়িত করার চেষ্টার মধ্যে হয়তো কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল না। তাই সংবাদপত্রের বিবরণেও স্বাভাবিক ভাবেই দেশি রাজা-জমিদারদের নিকেতনের দুর্গাপূজায় সাহেবসুবোদের আগমন, খানাপিনা, গানবাজনা, এমনকি, ‘গড সেভ দি কিং’ গাওয়ার পর্যন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন
পাথরের মূর্তি বদলে গেল মৃন্ময়ীতে, পেখম মেলল চালচিত্র

উদাহরণস্বরূপ বঙ্গদূত পত্রিকায় ১৮২৯ সালে ‘মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের দুই বাটীতে নবমীর রাত্রে শ্রীশ্রীযুত গবর্নর-জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক বাহাদুর ও প্রধান সেনাপতি শ্রীশ্রীযুতলর্ড কম্বরমীর ও প্রধান প্রধান সাহেবলোক’-দের আগমন ও ‘নানা আমোদ ও নৃত্যগীতাদি দর্শন ও শ্রবণ করত অবস্থিতি করিয়া প্রীত হইয়া’ গমন করার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। [১০-১০-১৮২৯]

আরও পড়ুন
কলকাতার বারোয়ারি দুর্গাপুজোয় মহিলা পুরোহিত, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ৬৬ পল্লীর

এই বিবরণের দু’বছর পরে ‘সমাচার দর্পণ’-এ মহারাজ কালীকৃষ্ণের বাড়ির দুর্গাপূজার তিন রাত্রিতেই নানা উচ্চপদস্থ ‘ইংরেজ ও বিবিলোকের সমাগমে’র বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লেখা হয়, ‘...অনন্তর মদ্য ইত্যাদি আহারীয় ও পেয় সামগ্রীর যথেষ্ট আয়োজন এবঞ্চ নট ও নটী ও কাশ্মীরী বালকখড়্গকর্মনিপুণ নানাবিধ তামাসা ছিল...।’[২২-১০-১৮৩১] ‘সংবাদ প্রভাকর’ ১৮৬৩ সালেও ‘শোভাবাজারে স্বর্গীয় মহারাজ রাজকৃষ্ণ বাহাদুরের নিকেতনে’ নাচের সভায় ‘অনেকানেক ইংরাজ সম্ভ্রান্ত বিবি ও বিস্তর এতদ্দেশীয় মহৎ ও মান্যব্যক্তির’ উপস্থিতির বিবরণ দিয়েছে। শুধু দেশি খবরের কাগজগুলিই নয়, ইংরেজদের পত্রিকাতেও সেকালে দুর্গাপূজায় সাহেব-আপ্যায়নের বর্ণনা নেহাত কম নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে নবকৃষ্ণ-ভবনে সস্ত্রীক বেন্টিঙ্ককে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে ‘গড সেভ দি কিং’ সুরধ্বনি, বাইজিদের নৃত্যগীত ইত্যাদি দ্বারা আপ্যায়নের বিবরণের পর ‘হরকরা’ পত্রিকাটি সহর্ষে লিখেছিল— ‘A sight so pleasing and grand was hardly ever before witnessed, for it was never known that the rulers of the country had thus designed to honour their festivities with their presence…’ [১২-১০-১৮২৯]।

জেন্টুদের বাড়ির উৎসবে সাহেব-সমাগম ও বাই-নাচের ছবি এঁকেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী মিসেস এস সি বেলনোস। ভারতে জন্মগ্রহণ করে এখানেই বেড়ে ওঠা এই কন্যাকে অবশ্য সঠিক অর্থে ইয়োরোপীয় বলা না গেলেও তিনি খুব সম্ভব ছিলেন পর্তুগীজ বংশোদ্ভূতা। ১৮৩০ সালে প্রকাশিত তাঁর অ্যালবামের [‘Twenty Four Plates Illustrative of Hindu and European manners in Bengal’] এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ও কার্পেট-শোভিত এক হলঘরে নাচছে এক সুরূপা নর্তকী, তার একপাশে নানা বাদ্যযন্ত্র সহ সুবেশ বাদ্যকরেরা দাঁড়িয়ে আছে, অন্য পাশে এক ইয়োরোপীয় অভ্যাগতের সঙ্গে আলাপ করছে এক সম্ভ্রান্ত ‘জেন্টু’ ও একজন শিখাধারী ভারতীয়।

ছবিটিতে অবশ্য বিশেষ ভাবে দুর্গাপূজার কোনো অনুষঙ্গ দেখা যায় না। তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই ছবিটিতে যেমন দেখানো হয়েছে, রাধাকান্ত দেবের বাড়ির দুর্গোৎসবেই সে-ধরনের সমাবেশ হত।

Powered by Froala Editor