কর্তৃপক্ষের সহানুভূতির ওপরই দাঁড়িয়ে ভারতের গণমাধ্যম ও প্রকাশনী সংস্থার ভবিষ্যৎ

করোনা অতিমারী তছনছ করে দিয়েছে গোটা পৃথিবীকেই। আর এই পরিস্থিতিতে শুধু স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার এবং পুলিশরাই নন, গণমাধ্যমের কর্মীরাও সমান পরিশ্রমে কাজ করে গেছেন। তাঁরাও তো ‘কোভিড-যোদ্ধা’। 

একেবারে গ্রাউন্ড জিরোতে থেকেও সাংবাদিকরা কাজ করেছেন এই সময়। অনেকে তো করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন। কিন্তু খবর সংগ্রহ থামেনি। গবেষণা বলছে, ২০২০-র জানুয়ারি মাস থেকে অতিমারী নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৪০০টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যা এক কথায় অভূতপূর্ব। 

কিন্তু, আর্থিক দুরবস্থা সংবাদমাধ্যমকেও ছাড়েনি। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে খবরের চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া— সমস্ত জায়গায় এর গুরুতর প্রভাব পড়েছে। আর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ভারতও এর থেকে বাদ নেই। একটু ২০২০-র এপ্রিলের কথা মনে করা যাক। তখনও গোটা দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন জারি আছে। আর তারই মধ্যে খবর এল, ভারতের একটা বড়ো সংখ্যক মিডিয়া হাউস তাঁদের কর্মী ছাঁটাই করেছে। যাঁদের চাকরি যায়নি, তাঁদের অনেকের বেতন কমে গেছে। বিজ্ঞাপন, সাবস্ক্রিপশনের মতো দিকে বাজেট কাটছাঁটও হয়েছে। তবুও পরিস্থিতি যে ভালোর দিকে যাচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। 

করোনার দুর্যোগ 

আরও পড়ুন
কোভিড-পরবর্তী কর্মক্ষেত্রে, কী ভাবছেন কর্পোরেটের মহিলা নেতৃত্বরা?

প্রধান প্রকাশনী সংস্থাগুলিও দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলেছে। লকডাউনের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান সব বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিক্রিবাট্টাও একদম থেমে যায়। অনলাইন সংস্থাগুলি কেবল জরুরি জিনিসপত্র (স্যানিটাইজার, মাস্ক, ওষুধ, খাদ্যদ্রব্য) ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত। কিন্তু বাকি জিনিস কেনাবেচা করা যেত না। 

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে বই বিক্রেতাদের। অনেক পরিকল্পনাও মাঝখানে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। অনেক ক্ষতিও হয়ে গেছে এর জন্য। বড়ো বড়ো প্রকাশনী সংস্থা, যাদের কাছে পুঁজি আছে, তাঁরা তবুও কোনোমতে টিকে গেছে। ছোটো ছোটো প্রকাশনী সংস্থাগুলি তো এতটাও ভাগ্যবান নয়। এখন যেখানে অর্থনীতিকে আবারও ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনার কথা চলছে, বই-ব্যবসা এবং বইয়ের দোকানগুলির ভাগ্য কোনমতে টিকে আছে। তবে ইতিমধ্যেই অনেক দোকান বন্ধও হয়ে গেছে। বাকিদের ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না… 

আরও পড়ুন
ভারতের কর্পোরেট-ক্ষেত্রে বাড়ানো উচিৎ সহনশীলতা, কিন্তু কেন?

টিকে থাকার উপায়

সংবাদমাধ্যম এবং প্রকাশনী সংস্থা যখন এই পরিস্থিতিতে আবার আলো খোঁজার চেষ্টা করছে, তখন মানসিক দিক থেকে সবার ঠিক থাকাটা খুবই দরকার। 

আরও পড়ুন
ভারতে অতিমারী-পরবর্তী কর্পোরেট চিত্র : বদল আনতে হবে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণেও

সাইকোমেট্রিক-ভিত্তিক সংস্থা নুভাহ এবং রিসার্চ ফার্ম বিয়াসিঙ্কের পজিটিভ সাইকোলজি-ভিত্তিক গবেষণায় মিডিয়া কর্তৃপক্ষ, প্রকাশনী সংস্থা ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলিকে ডাকা হয়েছিল। এবং এই মুহূর্তে টিকে থাকতে গেলে সমস্ত আচরণ ও দক্ষতার বিষয়গুলি নিয়ে আবারও ভাবা দরকার, এটাই বলছেন সবাই।

নিয়োগকর্তা-চাকুরীজীবীদের প্রত্যাশা 

এই ব্যাপারে সংস্থার অংশীদারদের ডাকা হয়েছিল এবং তাঁদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়েছিল যে বসের থেকে একজন কর্মীর প্রত্যাশাগুলি কী? এবং এর উল্টোটাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। 

হারপারকলিন্স পাবলিশার্স ইন্ডিয়ার সিইও অনন্ত পদ্মনাভন যেমন বলছেন, “প্রথমে তোমাকে তোমার সহকর্মীদের কথা শুনতে হবে ও বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের সমস্যার কথা শোনা এবং যথাসম্ভব সাহায্য করা। এবং তৃতীয়ত, একদম ঠিক নির্দেশ এবং দিশা দেখানো।”

ওই সংস্থারই সেলস ডিরেক্টর রাহুল দীক্ষিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন-
১) এই পরিস্থিতিতে আমরা সবাই একসঙ্গে লড়াই করব, একে অপরের পাশে থাকব— এই ভাবনাটা যেন সবার সামনে উঠে আসে।
২) আসল কাজগুলোয় যাতে টিমের ফোকাস থাকে, সেটা নিশ্চিত করা।
৩) টিমের থেকে প্রতিনিয়ত ফিডব্যাক চাওয়া, যাতে ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে পরিস্থিতিকে সামলানো যায়। 

প্রায় একই কথা বললেন বিবিসি ওয়ার্ল্ডের সিনিয়র প্রোডিউসার ইকবাল আহমেদ। তিনি বললেন, “অন্তত এই সময় দাঁড়িয়ে সহানুভূতি খুবই প্রয়োজনীয়। টিমের প্রতিটি সদস্য যেন মনে করে, সমস্ত পরিস্থিতিতে তাঁদের লিডাররা সঙ্গে আছে। আর এটাই তাঁদের মনোবল অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কাজের মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত আমেজও আসে। সেইসঙ্গে প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ বজায় রাখাটাও জরুরি।”

টাটা স্টিল কলকাতা লিটারেরি মিট এবং গেমপ্ল্যান স্পোর্টসের ডিরেক্টর মালবিকা ব্যানার্জি। তিনি বলছেন “ধৈর্য, টিমওয়ার্ক ও সবকিছুকে মানিয়ে চলার স্বভাবই সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখে। আমি প্রধানত সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকটিতেই আছি। করোনা অতিমারি আমাদের জায়গাটায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। বড়ো বড়ো কর্পোরেট সংস্থাগুলিও তাদের কর্মীদের বসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ছোটো প্রতিষ্ঠানগুলি আজও আমাদের কর্মীদের পাশে রয়েছি। এবং তাঁরাও আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদেরকে বিশ্বাস করেন। পরস্পরের প্রতি এমন মনোভাবই তো হওয়া দরকার।”

ওয়েব পোর্টাল প্রহর ডট ইনের ডিরেক্টর অনিতেশ চক্রবর্তীও এই টিমওয়ার্ক আর সহানুভূতির কথাও তুলে ধরলেন। “আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এখন অনিশ্চয়তা রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছেন, মানিয়ে চলার রাস্তায় হাঁটছেন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের সহানুভূতিপ্রবণ হতেই হবে। একজন মানুষ, তিনি আগে কীরকম কাজ করেছেন, সেটা মাথায় রাখলে হবে না।”

ভবিষ্যতের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন

অংশীদারদের বলা হয়েছিল, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে কাজের জায়গায় এমন কোন কোন দক্ষতা দেখতে চান, যা আপনাদের মতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মোট ২৪টি সেটের মধ্যে সাহস, টিমওয়ার্ক, দয়াপ্রবণতা, নিজস্বতা, বাস্তববাদী এই গুণগুলিই বারবার সামনে এনেছেন তাঁরা। 

বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রিয়াঙ্কা দত্তের মতে, নিজস্বতা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। “আমাদের স্বভাবই হল, ওপরমহল যা বলবে, যেরকমভাবে বলবে ঠিক তেমনটাই মেনে চলা। এর বাইরে গিয়ে আমরা কী ভাবছি? এমন ভাবনা, যা শুনে চমকে যাবে সবাই? এখানেই চলে আসে নিজস্বতা, সৃজনশীলতা। অনেক সময় নিজের ভেতর থেকেই একটা গণ্ডি টেনে নিই আমরা। তবে অনেকক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, সংস্থা নিজেই এমন নতুনত্বকে সামনে আনতে চায় না। এই দুটো ক্ষেত্রেই বদল আনা আবশ্যিক। একটা ব্যাপারকে কতটা নতুনভাবে সামনে রাখতে পারছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

পদ্মনাভন যেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন তথাকথিত ‘সফট স্কিল’-এর ওপর। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলিই এখনকার দিনে অত্যন্ত জরুরি। হারপারকলিন্সেরই রাহুল দীক্ষিতও বললেন, “অতিমারি শুরু হওয়ার আগে, আমরা একভাবে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভেবেছি। একভাবে কাজ করেছি। এখন সেই পরিস্থিতির বদল আনা দরকার। এমন কিছু ভাবা দরকার, যা এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একেবারে নতুন। কিছু কিছু পুরনো নিয়ম অবশ্যই ভেঙে দেওয়া দরকার। তা হলেই একটা মুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে, নতুন কিছু আসবে।”

দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ

এখানে ওই অংশীদারদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ভালো জায়গা যেতে হলে, কাজের পরিবেশে ঠিক কীরকম দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। তিনটে দিকের কথা বলা হয়েছিল— আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা এবং চরিত্রের দৃঢ়তা। বলা হয়েছিল ১০-এর মধ্যে কত দিতে চান আপনারা। অদ্ভুতভাবে, এই তিনটে বিষয়কেই যথেষ্ট ভালো নম্বর দিয়ে উৎরে দিয়েছেন তাঁরা। সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছে সহনশীলতা (৯.০)। তারপর আত্মবিশ্বাস (৮.৬৭) এবং দৃঢ়তা (৮.২৫)। 

রাহুল দীক্ষিত যেমন বলছেন, “আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে এটা সবসময় সাহায্য করবে না। সেক্ষেত্রে সহনশীলতা অবশ্যই সবার ওপরে আসবে।” বিবিসি মিডিয়ার প্রিয়াঙ্কা দত্তও বলছেন “প্রত্যেকটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাকে যদি একটাকে আগে রাখতে বলা হয়, তাহলে আমি অবশ্যই সহনশীলতাকেই রাখব।”

অনিতেশ চক্রবর্তীও একই জিনিসকে মাথায় রেখেই এগোতে চান। “আমরা এমন একটা পরিবেশে আছি, যেখানে দুশ্চিন্তা, অসুস্থতা ছড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। সবথেকে খারাপ মুহূর্তগুলিকেও গ্রহণ করতে হবে, একটা জেদ রাখতে হবে। আর সেজন্যই সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, আত্মবিশ্বাস অনেক সময় অতিরিক্ত জায়গায় চলে যায়। সেটাও হওয়া উচিত নয়।”

মালবিকা ব্যানার্জি এবং ইকবাল আহমেদের মতে, অন্যান্য বিষয়গুলির মতো আত্মবিশ্বাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “অবশ্যই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের সহনশীল হতে হবে। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব যখন একজন মানুষ নিজেকে চিনবেন, নিজেকে সম্মান করতে জানবেন, এবং সেই বিশ্বাসটি রাখবেন।”

Powered by Froala Editor