ভারতে অতিমারী-পরবর্তী কর্পোরেট চিত্র : বদল আনতে হবে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণেও

২০২০-র একদম গোড়ার কথা। তখনও করোনার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। একটি বিখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গেছি। আমার সঙ্গে যিনি ঘুরছেন, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে আছেন। নতুন লেকচার-রুম, লাইব্রেরি, ঝাঁ-চকচকে ক্যাফেটেরিয়া, সুন্দর লন— সমস্ত কিছুই ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। সবার শেষে এসে পরিচয় করালেন আসল জিনিসটির সঙ্গে। 

উনি বললেন, “এই কয়েকদিন আগেই আমরা আমাদের অন্যতম প্রধান একটি ক্লায়েন্টের জন্য ‘ওম্যান লিডারশিপ প্রোগ্রাম’ আয়োজন করলাম। দেশজুড়ে ৮০ জনেরও বেশি মহিলা ম্যানেজার এই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, এই ক্যাম্পাসেই।” ভেবেছিলাম বোধহয় এখনও কিছু তথ্য দেওয়ার বাকি আছে; কিন্তু উনি চুপ করে গেলেন। বাধ্য হয়ে আমিই জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এই প্রোগ্রামে কতজন পুরুষ অংশ নিয়েছিল? কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপরই সেই ভদ্রলোক বললেন, “এটা তো কেবল মহিলাদের জন্য, তাই না?”

এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ২০২০ সালটা সমস্ত মানবসম্পদ দফতরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অতিমারীর জন্য কর্পোরেট ক্ষেত্রে যে বদলগুলো আসা প্রয়োজন, সেগুলো তাঁরাই বুঝবে, জানবে। করোনা আসার আগে একজন মানুষের যে যে দক্ষতাগুলোকে উপেক্ষা করা হত, সেই ‘সফট স্কিল’গুলোকেই এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নিঃসন্দেহে, এটা একটা ভালো দিক। কিন্তু সমস্যা হল, কোম্পানির বেশিরভাগ জায়গায় এখনও সেই পুরনো প্রথাই বহাল রয়েছে। কাউকে না কাউকে তো সিস্টেমকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে, চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে…  

আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স কারা? 

আবারও ফেরা যাক সেই ‘ওম্যান লিডারশিপ প্রোগ্রাম’-এ। আপনি মানুন বা না মানুন, লিঙ্গ বৈষম্যের মতো ঘটনা এখনও ভারতে কাজের জগতে ছড়িয়ে আছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে এইরকম প্রোগ্রাম শুধু অকার্যকর নয়, অন্যরকম ঘটনাও ঘটাতে পারে। ধরা যাক, একটা বড়ো সংখ্যক প্রতিভাবান, কর্মঠ মহিলাদের মনে ভরসা বাড়ানো হল, ভালো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। তারপর? সেই তো তাঁদের ফিরে যেতে হবে ওই পরিবেশে, যেখানে অধিকাংশ কর্মীই পুরুষ।         

হ্যাঁ, এই সমস্ত জিনিসের প্রয়োজনও আছে। কিন্তু লম্বা দৌড়ের জন্য এটাই পর্যাপ্ত নয়! তাহলে প্রতিভাবান পেশাদার নারীদের জন্য একটা সংস্থা ঠিক কীরকম জায়গা রাখতে চায়? সমস্ত ধাপে, সমস্ত পর্যায়ে কি মহিলাদের নিয়োগ বেড়েছে? ধরা যাক এই পরিবর্তনগুলো করা হল। তাহলে এগুলো পুরুষ কর্মীদের মধ্যে কীরকম প্রভাব ফেলবে? তাঁদের দাবিগুলো কী হবে? এই প্রশ্নগুলো সমস্ত জায়গায় করা উচিত… 

আমাদের এখন ঠিক কীরকম দক্ষতার প্রয়োজন? 

তথাকথিত পন্থা ও নিয়মে না গিয়ে, আমাদের একেবারে নতুন করে এবং খুব গভীরভাবে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। বাজার, চাহিদা এবং প্রযুক্তি তো সবসময়ই একসঙ্গে থাকবে— এর প্রভাবটাই করোনা অতিমারী এসে আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো মানে কেবল চাকরির ক্ষেত্রে প্রচলিত ভূমিকাগুলোর বদলই নয়; বরং সেই ব্যাপারগুলোকে আরও নমনীয় হতে হবে। পুরনো পন্থা এখন আর কাজে আসবে না। তাই সমস্ত প্রশ্নকে অন্তত এই সময়ের নিরিখে আরও আরও প্রাসঙ্গিক হতে হবে। 

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কর্পোরেট ও বিজনেস লিডারদের ঠিক কীরকম মানসিকতার প্রয়োজন? ডব্লিউএফএইচ মডেলের নিরিখে পিপল ম্যানেজমেন্ট বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার মানে কী? এই মুহূর্তে এমন বিষয়গুলোর দিকে একটু নজর দিলেই একটা বড়ো, নতুন চিন্তার দিক খুলে যাবে। সেইসঙ্গে সহনশীলতা, সহযোগিতা, দ্রুততা, সৃজনশীলতার মতো গুণগুলোকে নিয়েও নতুন করে আলোচনা করা যাবে। এবং এই কথা বলতে গিয়েই বেশ কিছু মজাদার প্রশ্ন সামনে চলে আসবে। আচ্ছা, কীভাবে ‘সহনশীলতা’ বিষয়টা শেখানো যেতে পারে? বা প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও এর বিকল্প রাস্তাগুলো কী?

কীভাবে এমন দক্ষতাকে মাপব? 

এর জন্য বিগত বহু দশক ধরে বেশ কিছু সাইকোমেট্রিক স্কেল ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এখন এই জিনিসগুলোই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। প্রথম বিষয়টাই হল কন্সট্রাকশন, বা কেমন করে জিনিসটাকে দেখব আর তৈরি করব। স্কেলের সূচক, ধরণ, গঠন নির্বিশেষে এই মডেলগুলো একটি নির্দিষ্ট স্কিলসেটকে ধরেই এগোয়। এই জিনিসগুলোই আজকের দিনে বাধা সৃষ্টি করবে; কারণ আরও বেশি নমনীয় হতে হবে। সমস্ত জায়গাকে ধরে সাইকোমেট্রিক মডেল কাজ করবে। 

দ্বিতীয় বিষয়টাই হল কীভাবে আমরা এটাকে দেখছি; অর্থাৎ পন্থা। ট্র্যাডিশনাল সাইকোমেট্রিক ‘ডিজিস মডেল’ অনুসরণ করে, যা কিনা বহু পুরনো একটা পন্থা। রোগীর কিছু উপসর্গ দেখা গেছে, ডাক্তার এসে সেসব পরীক্ষা করবেন, আর ওষুধ দিয়ে দেবেন। এতেই সমস্ত কিছু সেরে যাবে। এটাই যখন কাজের জায়গার নিরিখে দেখা হয়, সেখানে কর্মীর ডেভেলপমেন্টের বিষয়টি চলে আসে। কিন্তু আগের নিয়মে চললে এই কাজটা বেশ জটিল, এবং সময়সাপেক্ষ। তোমার কী খামতি, সেটা দেখানোর পরিবর্তে তুমি কী পারো, তোমার আসল শক্তির জায়গা প্রতিভার জায়গা কোনগুলো সেটা দেখালেই সবথেকে ভালো ফল পাওয়া যাবে। 

এই অতিমারী-পরবর্তী স্তরে কোম্পানি ও সংস্থাগুলির উচিত এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ট্রেনিংয়ের জায়গাগুলিতে যাওয়া। এবং সেখান থেকে আবার নতুন করে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা, চর্চা করা। আর অবশ্যই, ব্যক্তি বা সংগঠনের শক্তির দিকে লক্ষ্য দেওয়া দরকার। সেটাই এই বাজারকে আবার তুলে ধরবে। 

Powered by Froala Editor