মানবসম্পদের প্রেক্ষিতে, দিন-দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কর্মীদের ব্যবহারিক দক্ষতাও

কর্পোরেট দুনিয়ায়, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ বিভাগকে দেখা হয় সহকারী হিসেবে। ব্যবসার জগতের দিকে তাকালে, মানবসম্পদকে কখনই নেতৃত্বের জায়গা থেকে দেখা হয় না। কিন্তু কোভিড-১৯ এই পুরো চিন্তাভাবনাকে বদলে দিয়েছে। এই মুহূর্তে হিউম্যান রিসোর্সের পক্ষে কাজটা বেশ কঠিনই হয়ে গেছে; কারণ যাবতীয় স্পটলাইট এখন তাদের দিকেই। প্রতিটা কোম্পানিকে একটু একটু করে আগের অবস্থায় ফিরতে হবে। অতিমারী ও অর্থনীতির এমন অবস্থাকে মাথায় রেখেও তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর এটা করার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভেতরের কাজের পরিবেশটাকে যতটা সম্ভব চনমনে ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে। সমস্ত খারাপ পরিস্থিতিকে মাথায় রেখেও বলা যায়, এই অতিমারি আমাদের সামনে নতুন কিছু রাস্তা খুলে দিয়েছে। 

আর এমন বিষয়গুলি মাথায় রেখেই বিশেষজ্ঞরা নজর রাখতে বলছেন মানবসম্পদ বিভাগের দিকে। কর্ন ফেরির প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, হিউম্যান রিসোর্স এখন সমস্তকিছুর কেন্দ্রে। এটিই এখন সংস্থার চালিকাশক্তি। কর্পোরেট সংস্থা অ্যাসেনচার বলছে, ভারতের প্রেক্ষিতে দেখলে এখন কাজের জায়গার সহনশীলতার দিকেই ফোকাস করা উচিত। এবং এমন পরিকল্পনা করা উচিত যা ধাপে ধাপে কাজের জায়গায় এই সহনশীল পরিবেশ তৈরি করবে। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবী জুড়েই এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এবং সেই অনুযায়ী কাজও করা হচ্ছে।

আপাতত বিশ্বকে একটু সরিয়ে রাখা যাক। ভারতের প্রেক্ষিতে দেখলে বলতে হবে, এই মুহূর্তে ভারতের সমস্ত মানবসম্পদ বিভাগ যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে হবে। শুধু সমস্যা নিয়ে নয়; সমাধান নিয়েও কথা বলতে হবে। এবং এই পুরো আলোচনা, ভাবনাচিন্তা যেন টিকে থাকা, ব্যবসার উন্নতির সঙ্গে কাজের পরিবেশ নিয়েও হয়। এটা অত্যন্ত বাধ্যতামূলক। 

নুভাহ এলিন্ট এলএলপি এবং বিয়াসিঙ্কের পজিটিভ সাইকোলজি-ভিত্তিক গবেষণায় এই এইচআর নেতৃত্বদের সঙ্গেই কথা বলা হয়েছে। এবং এই কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। এবং তাঁরা এও বলছেন, কেন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কর্মীদের সমস্ত আচরণ ও দক্ষতার বিষয়গুলি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কাজের জায়গার পরিবেশ নিয়েও তাঁরা ভাবছেন। 

নিয়োগকর্তা-চাকুরীজীবীদের প্রত্যাশা 

এই ব্যাপারে সংস্থার অংশীদারদের ডাকা হয়েছিল এবং তাঁদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়েছিল যে বসের থেকে একজন কর্মীর প্রত্যাশাগুলি কী? এবং এর উল্টোটাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিছু নির্দিষ্ট প্রত্যাশার কথা দু’তরফের কাছ থেকেই এসেছে। অন্তত ৫০%-এর মতে, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যারা প্রতিনিয়ত কোভিডের সঙ্গে লড়ে গেছেন। রাতদিন এক করে পরিশ্রম করে গেছেন। কলম্বিয়া এশিয়া হেলথকেয়ারের গ্রুপ সিএইচআরও জ্যাকব জ্যাকব বলছেন, “এখন আমাদের সেক্টরে প্রত্যেকে চাইছে সংবেদনশীলতা। কারণ প্রতি মুহূর্তে অসম্ভব মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।”

আরও পড়ুন
ভারতের কর্পোরেট-ক্ষেত্রে বাড়ানো উচিৎ সহনশীলতা, কিন্তু কেন?

লাভা ইন্টারন্যাশনালের সিএইচআরও দীনেশ্বর প্রতাপ সিং বলছেন, “এই মুহূর্তে সবার দরকার সহানুভূতি। যে নেতৃত্ব এই সহানুভূতি দেখাতে পারবে না, তাঁদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও সম্ভব নয়। কারণ গোটা বিশ্বে মানসিক অস্থিরতা চূড়ান্ত জায়গায় চলে গেছে। একটি সংস্থার মাথায় যারা বসে আছেন, তাঁদের অবশ্য করেই অন্যান্যদের অবস্থা, চাহিদাকে বুঝতে হবে। তা নাহলে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে।” ভারতী এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক সিএইচআরও স্বাতী মোরে মনে করছেন, এমপাওয়ারমেন্ট বা ক্ষমতায়নই এখন চাবিকাঠি। “এবং এই কাজে ভরসা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সেইসঙ্গে নতুন ভাবনা, নতুন নিয়ম তৈরি করা প্রয়োজন।”  

ভবিষ্যতের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন 

অংশীদারদের বলা হয়েছিল, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে কাজের জায়গায় এমন কোন কোন দক্ষতা দেখতে চান, যা আপনাদের মতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মোট ২৪টি সেটের মধ্যে অবথেকে বেশিবার বাছা হয়েছে ‘কিউরিওসিটি’ বা কৌতূহলপ্রবণতাকে। ৪৫%-এর ভোট পেয়েছে এটি। আর বাকিদের মধ্যে সততা, শেখার আগ্রহ, টিমওয়ার্ক, অধ্যবসায়ের মতো দক্ষতা বা গুণগুলিরও উল্লেখ আছে প্রথমের দিকে। 

আরও পড়ুন
ভারতে অতিমারী-পরবর্তী কর্পোরেট চিত্র : বদল আনতে হবে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণেও

ডেলয়েটের প্রাক্তন চিফ লার্নিং অফিসার এবং অন্ত্রেপ্রেনর বিজয় আইয়ার যেমন বলেছেন, “এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়, একটা মানুষ কত সৎ সেটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের জীবনে হোক, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হোক বা কাজের ক্ষেত্রে— সব জায়গায় এটা দরকার। এবং এসবের সঙ্গে কাজের জায়গাতে একটা ভারসাম্য আনা দরকার।”

এশিয়া প্যাসিফিক, আল্টিমেট্রিক ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের সিএইচআরও কৃষ্ণা মুনিরামাইয়ার মতে, কাজের জায়গায় একজনের শেখার ইচ্ছা এবং প্যাশন কতটা সেটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। “কর্মীদের এখন নিজেদের যাচাই করা উচিত। কোন কোন কাজে তিনি দক্ষ, সেটা যেমন চিহ্নিত করবেন; তেমনভাবেই কোন কোন জিনিসে তিনি দুর্বল সেটাও বোঝা দরকার। কাজের পরিবেশে টিকতে গেলে ওই জিনিসগুলো নিয়ে চর্চা করা দরকার। এবং এই পরিস্থিতির নিরিখে কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বদের, হিউম্যান রিসোর্স বিভাগকেও নতুন করে তৈরি হওয়া উচিত। নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত, যে মানুষগুলো আমার সংস্থায় কাজ করছে, তাঁদের আরও ভালোভাবে কী করে যুক্ত করা যায়। এবং আমি নিজেও কীভাবে যুক্ত থাকতে পারি, কী কী শেখা বাকি আছে।”

দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ

এখানে ওই অংশীদারদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ভালো জায়গা যেতে হলে, কাজের পরিবেশে ঠিক কীরকম দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। তিনটে দিকের কথা বলা হয়েছিল— আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা এবং চরিত্রের দৃঢ়তা। বলা হয়েছিল ১০-এর মধ্যে কত দিতে চান আপনারা। অদ্ভুতভাবে, এই তিনটে বিষয়কেই যথেষ্ট ভালো নম্বর দিয়ে উৎরে দিয়েছেন তাঁরা। সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছে দৃঢ়তা (৮.৮৯)। তারপর সহনশীলতা (৮.৭৮) এবং আত্মবিশ্বাস (৮.৪৪)। স্বাতী মোরে’র মতে, দৃঢ়তার সঙ্গে অধ্যবসায়ের একটা সম্পর্ক আছে। কৃষ্ণা মুনিরামাইয়া বলছেন, “বর্তমান সময় দেখা যাচ্ছে চারিদিকে হয় চাকরি চলে যাচ্ছে, নয়তো কর্মীদের বেতন কমে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত নেগেটিভ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই তিনটে জিনিসই ভীষণভাবে প্রয়োজন। বিশেষ করে চারিত্রিক দৃঢ়তা; তা না হলে বার্নআউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা।” জ্যাকব জ্যাকবও প্রায় একইরকম কথা বলেছেন। তিনিও বলছেন, ভবিষ্যত সময় কিছু করতে গেলে এই দৃঢ়তা থাকাটা খুবই জরুরি। 

আর এই পুরো আলোচনা থেকে একটা বিষয়ই উঠে এল। পুরনো যা কিছু নিয়ম, ফ্রেমওয়ার্ক আমরা মেনে এসেছি, সেসব কিছু এখন কাজ করবে না। নতুন করে সবটা তৈরি করতে হবে, নতুন করে কাজের পরিবেশে আলো ছড়াতে হবে। আর এই কাজটাই হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদের কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ।     

Powered by Froala Editor