দর্শকশূন্য গ্যালারি, ‘সেলিব্রিটি’হীন তালিকা ও একটি দীর্ঘশ্বাস : প্রসঙ্গ ইউএস ওপেন

সময়টা ২০০৭ কী ২০০৮ হবে। পরিষ্কার মনে পড়ে না, কেবল ভাবতে বসলে একটা ছবি ভেসে আসে - সেইসময়কার বাঙালি বাড়ির রাত্রিকালীন আহারপর্বের খানিক আগেই এসে বাবা টি.ভি চালিয়ে দিতেন। আর, সেই রঙিন টেলিভিশনের পর্দার ভিতর দিয়ে ১২-১৩ বছরের মেয়ের চোখের সামনে ফুটে উঠত সমুদ্রনীলের মতো একটা চারচৌকো বাক্সাকৃতি মাঠ, যার উপরে হাওয়ার মত ভেসে বেড়ানো দু'জন মানুষ প্রবল গতিতে ছোটাছুটি করছে। আর হাতে তাদের অস্ত্রের মতো করে ধরা ব্যাডমিন্টন র্যা কেটের মত দেখতে অথচ খানিক মোটা আর উচ্চতায় ছোটো একটি ভারী জিনিস (চোখে দেখে যা মনে হয়েছিল তখন), যেটা দিয়ে একটা হলুদ-সবুজ বলকে নিজেদের মধ্যেই এ-পাশ ও-পাশ করাচ্ছে সেই হাওয়া-মানুষ দুজন। নিজেদের মনে, নিজেদের ছন্দে।

মনে আছে, সেইদিন বাবা বলেছিলেন, এই খেলাটা লন টেনিস, আর এই বিশেষ নীল সমুদ্র চৌখুপি মাঠ আসলে ছিল বিখ্যাত আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের ব্লু হার্ড কোর্ট। আর খেলাটা? সেটা ছিল ইউ.এস ওপেন, বছরের চারটি বিখ্যাত গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে যার আমন্ত্রণ আসে সবার শেষে, হাডসন নদীর প্রান্তিক শহরে।

আভিজাত্য আর সময়ের বিচারে উইম্বলডন সবথেকে প্রাচীন গ্র্যান্ড স্ল্যাম হলেও, ইউ.এস ওপেন সময়কালের তালিকায় কিন্তু একেবারে ঘাড়ের কাছেই, দুই নম্বর (১৮৮১ সালে পথ চলা শুরু যার।

শুরুটায় এই গাঢ় নীলের হার্ড কোর্ট কিন্তু ছিল না একেবারেই। প্রায় ১৯৭৪ সাল অব্দি সবুজ ঘাসের মখমলে গালিচার মাঠ, ব্রিটিশ কোর্টের মতোই। তার পরবর্তী কিছু সময়, বলতে গেলে মেরেকেটে ওই ২ বছর (১৯৭৫-৭৭) সেইসময়টায় ছিল এখানে ফরাসি ক্লে-কোর্টের চমক। আরে, এক্কেবারে শেষে অর্থাৎ ১৯৭৮ সাল থেকে ২০২০ এর মাঠে নামার দিন পর্যন্ত বর্তমানের নীলচে হার্ডকোর্ট। তবে অজি ওপেনের মত সিন্থেটিক হার্ডকোর্ট নয়.. অ্যাক্রিলিক হার্ডকোর্ট, যার বিশেষত্বই তার নিজস্ব উপকরণসমূহ দ্বারা তৈরি কংক্রিট বেস।

আরও পড়ুন
১২০ বছর আগে, অলিম্পিকে খেলা হয়েছিল ক্রিকেটও; স্বর্ণপদক জিতেছিল কোন দেশ?

দীর্ঘ ১৩৯ বছরের যাত্রা ইউএস ওপেনের। চাকচিক্য, জাঁকজমক বা টেনিসপ্রেমীদের উৎসুক ভিড় সবক্ষেত্রেই এর উন্মাদনা তুমুল। বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্লামের ক্ষেত্রে যা বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু,এইবছরের গল্পটা খানিক হলেও বরাবরের থেকে আলাদা। এক তো সেই গেল মার্চ মাস থেকেই মহামারীর ছায়া, যার কবল থেকে এই মরশুমের ফ্রেঞ্চ ওপেন থেকে উইম্বলডন কিছুই রেহাই পায়নি। সেই গত ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। তারপর, করোনার আগমনে ক্রীড়াপ্রেমীদের টানা শীতঘুম আর একের পর এক বড় টুর্নামেন্টের স্বপ্নগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার হিড়িক প্রবাহমান।

তবুও, টেনিসবিলাসীদের কাছে শেষপাতে ফ্লাশিং মেডোর নীল কোর্টের উত্তেজনাই যা ভরসা ছিল, অল্প হলেও। সেইই ভরসা-আশা-উত্তেজনা-আবেগকে মাথায় রেখেই ইউ.এস.টি.এ ১৪০তম ইউএস ওপেনের কথা ঘোষণা করেছে, শহরের গভর্নরের সবুজ সঙ্কেত সমেত। চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী, অগস্ট মাসের শেষ সোমবার (৩১শে অগস্ট) থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যবর্তী উইকউন্ড অব্দি (১৩ই সেপ্টেম্বর) খেলা চলবে ঠিকই। কিন্তু, করোনার চোখরাঙানির দরুন এইবছরের চিত্রনাট্য বেশ আলাদা। যা দীর্ঘ ১৪৩ বছরের গ্র্যা ন্ডস্ল্যামের ইতিহাসেই শুধু নয়, কুইন্স পার্কের স্মৃতিপৃষ্ঠাতেও, এরকম কোনো বিষয়ের নথিভুক্তি হয়নি কখনো৷

বিষয়টি কী তবে? বিষয়টি হল দর্শকশূন্য অবস্থাতেই একটা গোটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম চলবে সবথেকে বৃহৎ দর্শকাসনের টেনিসপ্রাঙ্গনে। ভাবা যায়!

এ তো গেল আসর বসবার গল্প, এবার আসা যাক আসর জমানোর কথায়। একে তো আসর বসছে প্রায় জনশূন্য করোনা পার্কে (এক করোনার বুকে অপর করোনার কেত্তনে খেলাটার আসল মেজাজই চৌচির), তার উপর যদিওবা বিশ্বগণমাধ্যমের দয়াদাক্ষিণ্যে টেনিসবিলাসীদের রসনার স্বাদ ঘোলে মিটছিল বলে আশা করা যাচ্ছিল, তাও টুর্নামেন্টের দিন যত এগিয়ে আসছে তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সে গুড়েও বালি।

আরও পড়ুন
ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা দ্বিতীয় বাঙালি তিনি, প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়ে চ্যালেঞ্জ প্রতিপক্ষকে

দুনিয়াকাঁপানো করোনার কুনজর যে যেকোনো সময়েই অজান্তে বিপদ ডেকে আনতেই পারে, সেই আশঙ্কাই খেলোয়াড়দের ভাবিয়েছে। যার ফলে পুরুষ এবং মহিলা (উভয়ের সিঙ্গলস) খেলোয়াড়দের অনেকেই একে একে সরে দাঁড়িয়েছেন।

গতবারের পুরুষ এবং মহিলা সিঙ্গলসের দুই বিজয়ী যথাক্রমে নাদাল ও আন্দ্রেয়াস্কু-ই নন কেবল, না খেলার তালিকায় পাঁচবারের পুরুষ বিভাগের সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়ন ফেডেরার, নিক কাইরোগিস, ওয়ারিঙ্কা, জো-উইলফ্রেড থেকে শুরু করে মহিলাদের মধ্যে সিমোনা হালেপ, নাওমি ওসাকা, আশ্যলে বর্টি, স্ট্যাভোলিনা একে একে সমস্তই নামদামি ক্রীড়াবিদরা সরে দাঁড়িয়েছেন এখনো অব্দি। যা মোটেই সুখবর নয় আসন্ন টুর্নামেন্টের কাছে। যদিও, এবারের এটিপির ওয়েস্টার্ন আর সাউদাম্পটন ওপেন আয়োজকেরা কিন্তু সিনসিনাটির রড লেভার এরিনার গ্রাউন্ডের বদলে ফ্লাশিং মিডো-কেই নিরাপদ বলে ভেবেছে এই কোভিড প্রসঙ্গগত ক্ষেত্রে।

অথচ, টেনিসপ্রিয়দের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মূল আসর মাটি হওয়ার ঘণ্টা বেজেই গেছে, আটকানো বৃথাই শুধু বলা ভুল, একেবারে অসম্ভব৷

তবু, টেনিসপ্রেমীদের কাছে খানিক কিছু ভালো খবরও আছে বটে। সেই খবরের মধ্যে অবশ্যই একদিকে যেমন, টুর্নামেন্টের শীর্ষবাছাই তথা পুরুষবিভাগের অন্যতম প্রিয় জকোভিচ এবং মহিলা ফেভারিটস (সিঙ্গলস) সেরেনা উইলিয়ামসের খেলার সিদ্ধান্ত এখনো পর্যন্ত অটুট। অন্যদিকে তেমন, মিক্সড ডাবলস না দেখতে পাওয়ার দুঃখ ডাবলসপ্রেমীরা এবছরে কেবল পুরুষ এবং মহিলা দুই ভিন্ন ডাবলসের ম্যাচ দেখে মেটাবেন বলে আশা রাখি।

আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড় নোভাক জকোভিচ

তবুও, গল্পটা যেন হ্যাপি এন্ডিং হতে হতেও সবটা হ্যাপি হতে পারবে না। গল্পটার যেভাবে শুরু থেকে শেষ হওয়ার চিরাচরিত অভ্যস্ত ছন্দ ছিল, তা খানিক কেটে যাবে। থমকে থাকবে এবারে বিলি জিন কিং টেনিস সেন্টারের অন্দরে সেই চেনা উল্লাস, হবে না সেই চেনা ভিড় - প্রিয় খেলোয়াড়দের নিয়ে তীব্র আবেগ - চব্বিশ হাজারের উপর টেনিসানুরাগীর আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়ানো গভীর শ্বাসরুদ্ধকর শব্দব্রহ্মনাদ নিক্ষেপ গ্রাউন্ডের কোণে কোণে।

দেখা যাবে না ফেডেরার বুদ্ধিদীপ্ত প্রথম সার্ভের মুহুর্তে প্রতিপক্ষের চোখে হালকা টেনশন, থাকবে না নাদালের ফাইনাল ম্যাচ জিতে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের দেওয়া ট্রফির প্রান্ত কামড়ে ধরার সেই ভীষণ চেনা বাইট। থাকবে না নাওমি ওসাকার তীক্ষ্ণ গেম বের করে আনার ঠান্ডা মাথার দক্ষ সিদ্ধান্ত বা গতবারের চ্যাম্পিয়ন আন্দ্রেয়াস্কুর প্রতিদন্দ্বী চমকে দেওয়া ড্রপশটের ম্যাজিক কিংবা, জিতে যাওয়া নায়কনায়িকার মাঠের মাঝে অদ্ভুত জয়োৎসবের রকমফের। সবই থাকবে যেন, খানিক গৃহস্থ বাড়ির টানা বারান্দায় ভোর অব্দি জ্বলা সেই ম্লান হলদে আলোর মত মিয়ানো বেশে। অনুজ্জ্বল প্রতিধবনির ব্যাকগ্রাউন্ড শুধু আশেপাশে বাজবে আর অদ্ভুত জৌলুসহীনভাবে নমো নমো করেই ফুরিয়ে যাবে বছরের চতুর্থ তথা শেষ গ্র্যান্ড স্লাম উৎসব।

নিখাদ টেনিসপ্রেমী হিসাবেই শুধু নয়, পরবর্তী সময়ের নতুন মহামারী মুক্ত পুরানো ছন্দের পৃথিবী দেখার চরম ইচ্ছে বুকে রেখে বলতে পারি, না হয় সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা ভীষণ প্রিয় চারকোনা নীল কোর্ট ঘিরে চরম উত্তেজনা, রেফারির পরিচিত গমগমে স্বরে উল্লসিত আর্থার অ্যাশের দর্শকদের চুপ করানোর আর্জি, পছন্দের খেলোয়াড়ের দুরন্ত সার্ভ আর অ্যাস-ডিউস-অ্যাডভান্টেজে সাজানো দুর্দান্ত স্কোরলাইন আর ফ্লাশিং মিডোর দুনিয়াখ্যাত টেনিস যজ্ঞের ঝলকানি এবারে ব্রাত্য থাকবে। কিন্তু যেহেতু গ্র্যা ন্ড স্লাম শেষপর্যন্ত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাই শত সাবধানতা সচেতনতাসমেত পরবর্তী দু-সপ্তাহ চলা বছরের শেষ টেনিস উৎসবে হতেই তো পারে! যদি টেনিসবিশ্ব ট্রফি হাতে নতুন সম্রাট-সম্রাজ্ঞী পায়? বলা তো যায় না, তাই না?

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ক্রিকেট, ফুটবল, সাঁতার, টেনিস – রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ছিল সবেতেই

More From Author See More