খেলা আসলে বাঁচারই লড়াই, শিখিয়েছিলেন যে শিক্ষকরা

ময়দানের একফালি জমির উপর নেট টাঙিয়ে জোরকদমে প্র্যাকটিস চলছে। খোঁজখবর নিলে জানা যাবে, এই ফুটিফাটা সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবটার নাম সি-সি-এইচ। অর্থাৎ, ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলা। একটু কাছে গেলেই হয়তো দেখতে পাবেন, একটি দোহারা গড়নের ছেলে ফরোওয়ার্ড ডিফেন্স খেলে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে। পাশ ঢলঢলে প্যান্টপরা বেঁটে কালো রোগা চেহারার একজন মানুষ। ভাবলেশহীন মুখ। দৃষ্টি শহীদ মিনারের দিকে। হঠাৎ ছেলেটি প্র্যাকটিস থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তৎক্ষণাৎ বাজখাঁই গলায় নির্দেশ আসে, ‘দুশোবার শ্যাডো প্র্যাকটিস! হয়েছে?’ ছেলেটি আবার শুরু করে...

বেলা নিভু নিভু। মোহনবাগান মাঠে খেলা শেষ হয়েছে। হেরো দলের খেলোয়াড়রা পড়ে আছে ঘাসের উপর। নব্বই মিনিটের পরিশ্রমে বেঁকে গিয়েছে শরীর, জখম হয়েছে পা। মাঠের প্রান্তে পেটানো চেহারার একজন চেয়ারে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বয়স চল্লিশের উপর। শোনা যায়, এখনও এই হেরো টিমটার স্তম্ভ হয়ে রয়েছেন তিনি। খেলছেন শোভাবাজার স্পোর্টিং-এ। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাঁকার দিয়ে ওঠেন, ‘সলিল!’  নিকষ কদাকার একটি ছেলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসে। ভদ্রলোক পরিচয় করিয়ে দেন, ‘এ আমার ছাত্র... সলিল... পরিশ্রমী ছেলে...’।

ময়দান থেকে বেরিয়ে বাস ধরে গোলদীঘি। কম্পিটিশন জমে উঠেছে। জুপিটার ক্লাব আর এপোলোর সাঁতারুরা ঝড় তুলছে জলে। টাইমারের কাঁটাকে হারিয়ে দিচ্ছে কেবল একটিমাত্র কালো ছিপছিপে মেয়ে। অজস্র জলকণা সরিয়ে বাতাসে পাড়ি দিচ্ছে হাত। সমান তালে চলছে পা। ফিনিশ লাইনের সামনে ক্ষয়াটে এক প্রৌঢ় চেঁচিয়ে চলেছেন, ‘কাম অন কোনি! ফাইট! কোনি ফাইট!’ ভেঙে গিয়েছে গলা, কাশতে কাশতে বসে পড়লেন ফিনিশ বোর্ডে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেয়েটি বোর্ড ছুঁল সকলের আগে...

এমন অজস্র ননীদা, কমল গুহ, ক্ষীতিশ সিংহরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন, কলকাতা ময়দানের আনাচে কানাচে, মতি নন্দীর উপন্যাসের পাতায়। আধপাগলা, রগচটা, আবেগপ্রবণ মানুষগুলো নিজেদের হয়তো সবটাই দিয়েছিলেন ময়দানে, পাননি কিছুই।

স্টপার কমল গুহ, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী 'যুগের যাত্রী'-কে হারানোর অসম লড়াই চালিয়েছেন গোটা ফুটবলজীবন। সম্পর্ক ছিল না নিজের সন্তানের সঙ্গেও। সেখানে ঠাঁই পেয়েছিল ছাত্র - সলিল। স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে কৃতী তন্ময়ের জন্য ব্যাট কিনেছেন ননীদা। জলের মধ্যে ছিলেছেঁড়া যন্ত্রণার মতো 'খিদদা' তাড়া করে বেরিয়েছেন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন, সাঁতারু কনক চাঁপা পালকে।

 কমল গুহ ছিলেন পল্টু মুখার্জির ছাত্র। ইন্টারভিউ দিতে দিতে সগর্বে জামা খুলে দেখান, গুরুর মারের দাগ। চক্রান্ত করে কোনিকে ডিস্কোলিফাই করায়, উত্তেজিত খিদদার ঠোঁট ফাটে, মার খেয়ে। শত অপমান হজম করেও তন্ময়ের জন্য আত্মঘাতী রান আউট হয়েছিলেন ননীদা...

নাহ! এঁরা কেউ দ্রোণাচার্য পুরস্কারের যোগ্য নন! দ্রোণ তো পক্ষপাতদুষ্ট একটা মানুষ...

মতি নন্দীর কলম, ময়দানের মধ্যে আরো একটা ময়দানকে হাজির করে পাঠকের চোখে। আলো-আঁধারির মায়াজালে রমাকান্ত আচরেকর ননীদা হয়ে ওঠেন। কমল গুহ'র মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে অমল দত্তকে...

শেষ জোরটুকু উজাড় করে ডানা মেলে মা-পাখি... ছোট্ট ছানা, বাতাসে পাক খেতে খেতে খুঁজে পাচ্ছে আপন ছন্দ। মায়ের নাগাল ছাড়িয়ে, উড়তে উড়তে, হারিয়ে যায় সূর্যের কোলে।

জীবন দিয়ে শিক্ষা যে দেয়, সেই তো মাস্টার।

Powered by Froala Editor