অতিমারীতে শিক্ষার অন্যতম হাতিয়ার রেডিও

কোভিড-১৯। আচমকা একটা অতিমারী একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীকে এখনও কোথাও পুরোপুরি কোথাও বা আংশিক তালাবন্দি করে রেখেছে। তবু, যদি এর মধ্যে থেকেও ‘ভালো’টা খুঁজে নিতে হয়, তাহলে বলতেই হবে এই থমকে থাকা আসলে ফিরে দেখবার একটা সুযোগ। হয় আমরা এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখব, কিংবা আরও বিপন্ন হতে থাকব সময়ের স্রোতে। ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট’ অনুযায়ী, অতিমারীর আগেই গোটা পৃথিবীতে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে ছিল প্রায় ২৬ কোটি শিক্ষার্থী। অতিমারীর কারনে সারা পৃথিবীতেই যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, তখন তার বিকল্প হিসেবে শিক্ষার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে অনলাইনে। অথচ ঠিক তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রসংঘের (UN) তথ্য জানাচ্ছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ১৩০ কোটি স্কুল শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত। এনএসএস (২০১৮)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে কেবলমাত্র ২৪% পরিবারের কাছে সুযোগ আছে ইন্টারনেট ব্যবহারের। এই দেশের প্রায় ৬৬% মানুষেরই বসবাস গ্রামে। সুতরাং, এই ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর প্রেক্ষিতে ভেবে দেখতে হবে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এই কঠিন সময়ে? যেখানে ইলেকট্রিক আলোই নেই সেখানে স্মার্টফোন, ফোর-জি বা অনলাইন ক্লাসের মতো শব্দগুলোর অস্তিত্ব কতটা তাদের অভিধানে? তাহলে? কোন পথে এগোবে সার্বিক শিক্ষা?

এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে রেডিও (Radio) বা বেতার ব্যবস্থা, কিছুদিন আগেও শহুরে সভ্য সমাজ যাকে ঠেলে দিয়েছিল প্রায় বাতিলের খাতায়। মহামারীর প্রকোপে, দুর্যোগের ফলে অথবা যুদ্ধকালীন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার শিশু যখন স্কুলের চৌহদ্দিতেও পা রাখতে পারছে না, তখন রেডিওর মাধ্যমে এক বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থাই মূল ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পেরেছে তাদের। ইউনেস্কোর তরফেও তাই তাদের নিজস্ব রিপোর্টে জানানো হয়েছে, অনলাইন ক্লাস যেখানে সম্ভব নয় সেখানে রেডিওই হয়ে উঠেছে এক বিকল্প এবং কার্যকরী শিক্ষার উপায়।

প্রশ্ন হল, কীভাবে সম্ভব হল রেডিওর এই পুনরুজ্জীবন? আসলে রেডিও ঠিকই থেকে গিয়েছিল সমাজের সেই অংশের কাছে, যেখানে বিনোদনের বিকল্প উপায়গুলি সহজলভ্য নয়। তথাকথিত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ না থাকায়, প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের বন্ধু হয়ে উঠেছে সেই রেডিও। এই বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোতে এই সঙ্কটে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জায়গা থেকে সবথেকে বেশি সহায়ক হয়ে উঠেছে রেডিও। মেক্সিকোর টিভি ও রেডিও সংক্রান্ত একটি গবেষণায় তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, কীভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে রেডিওর মাধ্যমে ক্লাস। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেভাবে খুব সহজভাবে সামান্য প্রযুক্তির মাধ্যমে স্পেশাল এফেক্ট, মিউজিক বা বাচনভঙ্গির সাহায্যে নাটকীয়তা তৈরি করে বর্ণনা করা হচ্ছে এক একটি বিষয়, তাতে পাঠ্য বিষয় শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এবং তাদের মনোযোগ ধরে রাখতেও সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে রেখে একনাগাড়ে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা গেলানো নয়, বরং স্থানীয় সংগীত, লোককথা বা উপকথাকে ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষার উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে, যা নির্মিতিবাদের ‘পেডাগজি’র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত গবেষণামূলক নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, স্কুলগুলিতেও যদি নিয়মিত ভাবে রেডিওর মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে স্কুলছুটের সংখ্যাও কমত অনেকটাই।

রেডিওর জনপ্রিয়তা এবং কার্যকারিতা যে এখনও প্রাসঙ্গিক, তা মূলত দুটি প্রধান চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণে। প্রথমত, রেডিওর সহজে যোগাযোগ করার ক্ষমতা এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর উপর তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীলতা না থাকা। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেডিওর খরচ অন্য সব মাধ্যমের থেকেই কম। শুধুমাত্র একটা রেডিও সেট আর ব্যাটারি ছাড়া সেভাবে আর কোনও খরচও করতে হয় না শ্রোতাদের। যে কোনও বিশেষ ঘটনা সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার করে ফেলা যায় রেডিওতে। চলাফেরা করতে করতেও দিব্যি শোনা যায় রেডিও। অর্থাৎ, ‘টাইমলিনেস’ অর্থাৎ ‘সময়োপোযোগিতা’ এবং ‘মোবাইল’ অর্থাৎ ‘সঞ্চরণশীলতা’, যোগাযোগ মাধ্যমের এই দুটো প্রাথমিক এবং উল্লেখযোগ্য শর্তই বেতার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে খেটে যায় সহজেই।

আরও পড়ুন
থামল ৬৩ বছরের যাত্রা, আমেরিকা থেকে বাংলায় রেডিও সম্প্রচারে ইতি

তবে এর সব থেকে বড়ো ইতিবাচক দিকটা হল, রেডিওর মাধ্যমে স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুবিধা। বুনিয়াদি শিক্ষায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই যে শিক্ষা প্রসারের সব থেকে বড় হাতিয়ার, সেটা গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত। তাই ‘মাইক্রো-লেভেল’ বা তৃণমূল স্তরেও রেডিওর সহজ উপস্থিতির কারণে, বিভিন্ন স্থানীয় বা উপজাতীয় ভাষাতেও সম্প্রচার করে ফেলা যায় রেডিও অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র হিন্দিতেই সম্প্রচার, অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কোপে বাংলা সহ ১২টি ভাষা

এ ছাড়াও গবেষণা দেখিয়েছে, দীর্ঘকালীন সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে তৈরি হতে পারে ভয়, উদ্বিগ্নতা, খিদে কমে যাওয়া বা ঘুমের সমস্যা। এর ফলে গভীর অবসাদ বাসা বাঁধতে পারে তাদের মনে। এইসব ক্ষেত্রেও কাউন্সেলিংয়ের জন্য রেডিওকে ব্যবহার করা  যেতে পারে কার্যকরী ভাবে।

আরও পড়ুন
রেডিও বিস্ফোরণের স্থানাঙ্কের নির্ভুল নির্ণয়, নিউকম্ব ক্লেভল্যান্ড পুরস্কার পেলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী

ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান বিভাগের তরফেই জানানো হয়েছে যে, মহামারীর সময় কোনোরকম ভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহার করার মতো জায়গায় ছিল না, এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। আরও প্রায় ৬ কোটি মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করেন, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কই নেই। এর সঙ্গে যদি বিশ্বের সেই অঞ্চলগুলির ছাত্র-ছাত্রীদের যোগ করে নেওয়া হয়, যেখানে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎই থাকে না তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতাটা বোঝা যাবে আরও একটু। তার সঙ্গেই বোঝা যাবে রেডিওর মাধ্যমে সহজ শিক্ষা প্রসারের গুরুত্বটা।

ভারতের মতো দেশেও এই মহামারী আক্রান্ত সময়ে শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে রেডিও মাধ্যম। শুধুমাত্র সরকারি রেডিও বা শহরভিত্তিক এফএম চ্যানেলগুলোই নয়, এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন কমিউনিটি রেডিও স্টেশনগুলোও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার নিত্যানন্দ জনবাণী কমিউনিটি রেডিও স্টেশন লকডাউনের সময় ঘরবন্দী ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যার্থে সিধু-কানু-বিরসা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে মিলিত ভাবে একাধিক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে গিয়েছে নিয়মিত। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের স্পেশাল ক্লাস তো ছিলই, এমনকি যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে ফোন-ইন পদ্ধতিকেও কাজে লাগানো হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য। যদিও কমিউনিটি রেডিওর ক্ষেত্রে মাত্র সাত কিলোমিটার ব্যাসের পরিধির মধ্যেই এই রেডিও অনুষ্ঠান শোনা যায়, তবে এক্ষেত্রে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছোতে হাতিয়ার করা হয়েছে সেই প্রযুক্তিকেই। শুধুমাত্র পুরুলিয়া জেলাতেই নয়, যে কোনও জায়গাতেই যেখানে ইন্টারনেটের সুবিধা মিলবে, সেখানে রেডিও স্টেশনের নিজস্ব অ্যাপের মাধ্যমে এই সমস্ত অনুষ্ঠান শুনতে পারবেন সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরাও।

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের সুবিধাটাও মাথায় রাখা দরকার। ইন্টারনেটের অপ্রতুলতার কারণে সমস্যা তো আছেই, প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষকেরাও নতুন ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে সড়গড় না হওয়াতে সমস্যায়  পড়েছেন অনলাইন ক্লাস নিতে গিয়ে। তার উপর ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বহু মানুষের কাছেই স্মার্টফোন এখনও একটা ‘লাক্সারি’। এইসব শিক্ষকেরা তার থেকে বরং অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন রেডিওতে ক্লাস নিতে। ফলে নিজেদের মেলে ধরতে সুবিধা হচ্ছে তাদেরও।

সুতরাং নতুন করে রেডিও মাধ্যমের বেঁচে ওঠে না বলে একে বরং বলা যায় নতুন করে চিনে নেওয়া মানবসমাজে প্রযুক্তিগত বিনোদনের প্রাথমিক হাতিয়ারটিকে। মহামারীর অভিজ্ঞতা থেকে শিখে তাই আরও বেশি করে শিক্ষামূলক বিনোদনযোগ্য অনুষ্ঠান যদি ফিরিয়ে আনা যায় এই মাধ্যমে, তাহলে একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক রুচি ফিরবে, প্রসার বাড়বে প্রান্তিক শিল্পের, অন্যদিকে তেমনই উপকৃত হবেন লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক শিক্ষার্থীরাও।

(লেখকদ্বয় যথাক্রমে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স’ ট্রেনিং-এর অধ্যাপক এবং প্রাক্তন কমিউনিটি মিডিয়াকর্মী।)

তথ্যসূত্র:
১. El aprendizaje por conducto de la radio y la televisión en tiempos del COVID-19, UNESCO
২. Whatsapp, tele y radio: los más usados para educar durante la pandemia, BELÉN HERNÁNDEZ
৩. La radio, aliada contra la pandemia en África, IÑAKI MAKAZAGA, El Pais

অন্যান্য সূত্র:
১. Lessons through loudspeakers, community radio to help bridge digital gap in education, Kritika Sharma, The Print
২. Now Odisha turns to radio for classes, Satyasundar Barik, The Hindu
৩. Lessons through radio for students of Classes 10 and 12, The Hindu
৪. সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিয়োয় পড়াশোনা, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor

More From Author See More