‘পথের পাঁচালি’রই কি প্রত্যুত্তর পাই কমলকুমারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ!

‘কমলবাবু’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় লিখছেন, ‘...(‘পথের পাঁচালি’ দেখে)  হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। ...পরে বুঝেছি যে গ্রামবাংলা নিয়ে ছবি করে কমলবাবুকে খুশি করা আমার সাধ্যের বাইরে।’ 

অভিমানটা শেষ বয়েসে থেকেই গেছিল। ১৯৯২ সালে জ্যোতির্ময় দত্তকে তিনি বলছেন, ‘এ-রকম ছিল কমল। কমল মজুমদার। আমার ‘পথের পাঁচালি’ দেখে বলেছিল, ‘খুব খারাপ।’ ...আমি ওর ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ পড়েছিলাম, ভয়ানক ভালো লেগেছিল। পরে ওয়েভ-লেংথ বদলে গেল।’ মতভেদ হলেও কখনোই শ্রদ্ধার কমতি ছিল না সত্যজিতের। ...‘ওনার প্রথমদিককার গল্পে দেখেছি কী অসম্ভব সিনেমার সম্ভাবনা আছে’।

সকলেই মোটামুটি জানেন ‘পথের পাঁচালি’ দেখে সেই ‘কুখ্যাত’ মন্তব্য, ‘ঐ চিনিবাস ময়রার পিছনে অপু-দুর্গার ছুটে যাওয়ার সিনটা ভালো।’ দেড়খানা শট মোটে পছন্দ হয়েছিল ‘কমলবাবু’র, যা নিয়ে বিস্মিত-হওয়ার সঙ্গে রসিকতাও কিছু কম হয় নি পুরোনো বাঙালির আডায়। 

অনেকটা ভয় আর খানিক সমীহের সঙ্গে আমরা সেই লেখাটা পাশ কাটিয়ে এসেছি বরাবর। ‘সুহাসিনীর পমেটম’ নভেলাটির কথাই বলছি। ১৯৬৬ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লেখাটি বেরোলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও ‘অহীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ছদ্মনামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উলটোদিকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লেখেন ‘ভাষা ও অমরতা’, যেখানে অল্প দুর্বিনয়ের সঙ্গেই জানানো হয়, ‘সুহাসিনীর নামপত্র শুধু পড়েছি এবং ভবিষ্যতে কমলবাবুর যত লেখাই বেরোবে তার নামপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়ব না।’ 

সে বারে বঙ্গ-সংস্কৃতি মেলায় কমল মজুমদার সবে ঢুকছেন। স্টলের ভিতরে তরুণ প্রবন্ধকারকে দেখেই বলেন, ‘বাবু সন্দীপন, তুমি আমার বাপের কাজ করেছ!’ ...‘এমন সব রসিকতাও চলত ওদের’, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন ভাস্কর চক্রবর্তী। 

কিন্তু ‘সুহাসিনী...’র কথাই বা কেন? সহৃদয় পাঠক বুঝবেন আশা রাখছি। ‘উদ্ভিন্না যুবতী, শকুন্তলার চেয়েও সুন্দরী’ সুহা এবং ‘ব্রাহ্মণের ঔরসে কামিন রমণীর পুত্র’ লখাই, এই দু’জনে অযথাই লেখাটির মূল চরিত্র হয়ে আসেনি। 

আরও পড়ুন
বার্গম্যান, তারকোভস্কি-র মতোই শব্দের অভিনব প্রয়োগ মেলে সত্যজিতের ছবিতেও

...ফাটিয়ে ছবি আঁকেন, অজস্র লেখেন ও কমল মজুমদারের ফিদা-ফ্যান কৌশিক সরকার এক নিভৃত আড্ডাতে এই নিবন্ধকার-কে (আমায়) বলেছিলেন, ‘প্রথম ছবি নিয়ে সত্যজিতের ঐ রকম খ্যাতি! কমলবাবু তো জবাব দিয়েছে। ‘সুহাসিনী...’-তেই দ্যাখো না, আবার একটা ‘পথের পাঁচালি’ তুলেছে।’ স্তম্ভিত হয়ে আমি তখন ভেবেছি, ‘অথচ এতদিন খেয়াল করিনি!’  ...স্বভাবসিদ্ধ ঔদাসীন্যে কৌশিকদা আরো বলেন, ‘আর সেই দ্যাখো, কমলবাবু বড্ড সিনেমাটিক। এইটা একদম পছন্দ হয় না আমার।’

গ্রাম্য বালক ও তার পাতানো দিদি, লখাই-সুহাসিনী টো-টো ক’রে ঘুরে বেড়ায় বাংলার গ্রামে, সময় তিরিশ দশক, বন্দুকের ধোঁয়া উড়লে যখন ‘বন্দেমাতরং’ ধ্বনিত হয়। শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগ রেখেছে একটা রেললাইন, হুবহু যা মেলে ১৯৫৫ সালের সিনেমার সঙ্গে। মনে করুন অতুলনীয় সেই সিকোয়েন্সটি - উজ্জ্বল সকালবেলা, দুর্বাঘাস তুলছে বালক ও বালিকা। ‘ভাল দেখে সুন্দর সুন্দর দেখে দুব্বো তোল দুব্বো আস্তে আস্তে তুলতে হয় দুৎ... সবুজ দেখে’,... এবং, ‘এই বাক্যধারা শ্রবণে লখাই বিস্ময়ে মাঠের দিকে তাকাইল, ঘাসের মধ্যেও এত সুন্দর আছে এ সত্য ভাবিতে সে কেমন ভীত, পরক্ষণেই হাসিল’। ...দুর্লভের কাকী এসে জাতপাত বিষয়ে ফ্যাকড়া তুললে সুহা ঘৃণায় মুখ ফেরায়, ... ‘তা হ্যাঁ বামুনের মেয়ে তুমি নোংরা বুঝি! তা আর কাউকে পেলে না ওকে দিয়ে... শেষটায়’, ... ‘ওতে কি দোষ’, মুখ ঝামটা দিয়ে সুহা মুখ ফিরিয়ে লখাইকে বলে, ‘নে নে তুই তোল না, বোস্টম দেখে যে তোর ভাব লাগল’...!

জীবন্ত এই সংলাপ মনে পড়াবেই বিভূতিভূষণকে, আঁচ পাওয়া যাবে কমল মজুমদারের প্রসিদ্ধ শৈলীরও।  কম্পোজিশন, দৃশ্য-মন্তাজ কিংবা শব্দ-যোজনা সবই উশকে দেয় সিনেমা-দেখবার অভ্যাস। তিরিশ বছরের যুবক সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের উপন্যাস এডাপ্ট করেছেন সেলুলয়েডে, পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় কমল মজুমদারও ফিরে একই কাণ্ড করছেন, যদিও তা সাইকেডেলিক টানা লিখনেই - যার দৃশ্য-শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ আচ্ছন্ন করে রাখবেই পাঠককে, ঝুঁকি নিয়ে একবার হলেও যিনি পুরো নভেলাটি পড়ে দেখেছেন!  

আরও পড়ুন
গুপীর চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র, রাজি হননি সত্যজিৎ

একদিকে লখাইয়ের কামিন মা ও লখাই নিজে, অন্যদিকে সুহা ও সুহার বাবা অক্ষয় মাস্টার – এ কি নিশ্চিন্দিপুরেরই এক ডিসটর্টেড ছবি? কমলবাবু বদলেছেন অনেক কিছুই, লখাইকে জারজ সন্তান হিসেবে দ্যাখানো প্রায় সাবভার্শন, নয় কি? বিয়ে হয়ে গেছে সুহাসিনী, স্বামী তাকে ঘরে নেয় না, যে সুহা রূপসী ও অতীব মুখরা, দুর্গা-র মতোই তার দস্যি গেছোমি, দামালপনা। লখাই-সুহাকে কেন্দ্রে রেখে যোহন একাদশী, লক্ষ্মণ চাটুজ্যে, শৈবালী, উষা, কামিনীদিদি, আল্লারাখা... এরা সবাই চারপাশেই থাকে, বলা ভালো ভরিয়ে রাখে অপরূপ জগতটি। কখনোই যা বদলায় না, না বিভূতিভূষণ না সত্যজিতের থেকে, তা হল ল্যান্ডস্কেপ, সেই একই ম্যুরাল; সরল বিশ্বাস, ম্যাজিক আর সবুজে ছেয়ে-থাকা প্রেক্ষাপটখানি। 

একটানা, অবিরাম, বিপর্যস্ত নভেলার অন্তে কমলবাবু যখন লেখেন, ‘এ ঘোর বাস্তবতার পিছনে রামধনু আকাশ ব্যপ্ত করিল, অচিরাৎ কিসের আবেগে লখাই মথিত’, তক্ষুনি আমরা বুঝি ভিশ্যুয়ালটি আগের মতোই সাদা-কালো না রেখে রঙে উপচে তুলছেন লেখক, ‘যোহন একাদশীর ডোঙা বিদ্যুৎবেগে আসিয়া উহাদের ডোঙায় প্রচণ্ড আঘাত প্রাপ্ত হয়, লখাইয়ের সমক্ষে দৃশ্য টলায়মান’, ...ঠিক যেন একটি পয়েন্ট অব ভিউ শট, লখাইয়ের চোখ থেকে দৃশ্যটা দেখছি আমরা,  ‘...চেন সুতলী মুষ্টীবদ্ধ যাহা ছিল, তখনই নিমেষেই মুক্ত, ফলে পাখী উড়িয়াছে, ...এখন তিনজন সাঁতার কাটে, ভীত চকিত পাখীটি চক্র দিয়া... আকাশ পথে... যেহেতু সে স্বাধীনতা বিশ্বাসী তাই সে বলিয়াছে যে ইহা কি সুন্দর ইহা কি সুন্দর ইহা কি সুন্দর’... আমাদের ভিতরেও শুরু হয় আকুল সেতারের ঝালা, স্মৃতি আর স্বপ্নে ভর রেখে জাগে অপরিসীম সিনেমা।  

ঋণঃ কৌশিক সরকার

আরও পড়ুন
যে অভয়ারণ্যে পাখির কলকাকলি, ত্রস্ত হরিণের সঙ্গে রয়েছেন বিভূতিভূষণও

(উদ্ধৃত অংশে পুরোনো বানানবিধি অনুসরণ করা আছে)

Powered by Froala Editor