মুছে আসা শালবন, মুছে আসা বাংলা, ফুলডুংরি পাহাড়— এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ

বিকেলের শেষ আলো স্টেশনের গায়ে লেগে। রাঙা ও তপ্ত। স্টেশনঘরে দু-একজন। চুপচাপ। সন্ধের পর যাত্রীবাহী ট্রেন বিরল। তবে ধিমাধিমা চলে মালগাড়ি। ঘটোঘটো ঘংঘং শব্দে। স্টেশন কাঁপিয়ে। সেই গাড়ি দূরে মিলিয়ে গেলে শান্ত হয়ে আসে গোটা চত্বর। ১-২-৩টে প্ল্যাটফর্ম।

ঘাটশিলা স্টেশন। আমাদের অনেকদিনের আত্মীয়। কত দীর্ঘদিনের পরিচয় তার সঙ্গে। আমার যদিও আগে কখনো যাওয়া হয়নি। তবে মায়ের মুখে কতবার শুনেছি সেই দেশের কথা। সুবর্ণরেখার বালুকণায় সোনা মিশে থাকে! ট্রেনে যেতে যেতে মা কবেকার শোনা সেসব গল্প বলতে থাকে। মায়ের ছোটোবেলার এক বড়ো সময় কাটে ঘাটশিলায়। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় কাজ করতেন দাদু। নানা জায়গায় ঘুরপাক চলত। সঙ্গে চলত পরিবারও। ঘাটশিলায় শালবনের মাঝে ছিল তাঁবু। ঘাটশিলার কথায় মায়ের ছোটোবেলার গল্পগুলো ভেসে ওঠে। তাই আমাদের এই বেড়াতে যাওয়ায় মায়ের উৎসাহই ছিল সবচেয়ে বেশি।

স্টেশন থেকে নেমে অটো ধরে হোটেল। পৌঁছানোর সময়ই টপকাতে হল ফুলডুংরি পাহাড়। ঘাটশিলার ভৌগোলিক পরিচিতি আমাদের অজানা নয়। ছোটোনাগপুর মালভূমির ঢেউখেলানো পাথুরে উপত্যকা ছড়িয়ে রয়েছে ঘাটশিলা জুড়ে। একধারে এসে মিশেছে দলমা পাহাড়ের শ্রেণি। ঘাটশিলাকে বাংলার বাইরে ভাবতে একটু বেগ পেতে হয়। অন্তত হত কিছুদিন আগে পর্যন্তও। বাঙালি পাড়া, পল্লি- যেন বাংলারই এক প্রসারিত অঞ্চল। বাঙালির স্মৃতিতে ঘাটশিলার উপস্থিতি জোরালো। কত গল্প, উপন্যাস, কবিতায় ছড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের কথা। কলকাতার বাবুদের রোগমুক্তির অন্যতম ঠিকানা। স্বাস্থ্যকর জলহাওয়া মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিত। রোগ সারাতে এসে টের পেতেন এমন পকেটসাশ্রয়ী স্থান পৃথিবীতে আর নেই। হয়তো বলতেন, ‘ড্যাম-চিপ’। সেখান থেকে ঘাটশিলার অরণ্যচারী মূলবাসী মানুষের কাছে বাঙালি হয়ে ওঠে ড্যাঞ্চিবাবু।

শুধু এটুকুই নয়। ঘাটশিলাই তো একদা ছিল বাঙালির উতলে-ওঠা রোম্যান্স-ক্ষেত্র। ‘তুমি নিয়ে চলো ছায়ামারীচের বনে…’ - শাল-মহুয়ার আদিম জঙ্গল বাঙালির প্রেম আখ্যানের কথা চিরকাল শুনে এসেছে। সেই কতদিন আগে কোন ঘুরপথে পালামৌ এসে পৌঁছেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। তারপর থেকে পালামৌ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বাঙালির চিরস্থায়ী ঠিকানা।

অতীত স্মৃতি রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সেখান থেকে বেরোতে পারা কঠিন। আর সত্যি বলতে কী, বেরোতে চাইওনি তেমন। কিন্তু, বাস্তবতা বাধ সাধল। অক্টোবরের ঘাটশিলা। আমাদের ধারণা ছিল অন্তত রাতের বেলা বেশ হিমেল হবে চারপাশ। কিন্তু কোথায় কী? গুমোট গরম রাত্রি। গাছের একটা পাতাও নড়ে না। সকালবেলা একে একে ধারাগিরি জলপ্রপাত, গালুডি, নদীতট ঘুরেও শীতল হওয়া হল না। অটোচালক আমাদের বলতে বলতে যান প্রবল জলকষ্টের কথা। “বছর জল হয়নি একেবারে। ক্যানেলগুলো সব শুখা পড়ে আছে।”

শুধু শোনা-কথা না। বাস্তবিকই চোখে পড়ল শুকনো খটখটে খালগুলি৷ একবিন্দু জল আর তাতে নেই।

খুব করে চোখে পড়েছে জঙ্গলের দ্রুত ফুরিয়ে আসা। অটোর দাদা ট্যুরিস্ট ঘোরাচ্ছেন। ফলে ‘ট্যুরিস্ট স্পট’-এর বর্ণনা দিতে দিতে গাড়ি হাঁকান। বাহা সিরিয়ালের শ্যুটিং কোন জায়গায় হয়েছিল-- সেসবের এক চক্কর লাগান। অথচ জায়গাটার বদলে যাওয়ার যন্ত্রণাটা চেপে রাখতে পারেন না। সবথেকে বেশি আগ্রহ নিয়ে মা চারপাশ দেখতে থাকে। দেখে যত, মুখ বেজার করে ততই। “সুবর্ণরেখার তো জলই নেই রে…”, “এইসময় তো এত গরম থাকে না!”, “শালগাছ এত কম কেন? আমরা ছোটোবেলায় যেখানে ছিলাম, ঘন শালের জঙ্গল… আর মহুয়া গাছের তলায় দাঁড়ানো বারণ ছিল। গন্ধেই নেশা…”। ঘ্রাণেন অর্ধভোজং আর কি।

টিলা ভেঙে ঘুরে চলা অব্যাহত থাকে। গল্পও মিশতে থাকে তাতে। ঘাটশিলা শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে জঙ্গল বিস্তৃত। ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রাম। ট্যুরিস্টদের জন্য সামান্য দোকানঘর। রঙিন চিপ্স, বাহারি লজেন্স আর মিনারেল ওয়াটারের বোতল। অথচ সেসব গ্রামেই পানীয় জলের তীব্র হাহাকার। পথে ইতিউতি চোখে পড়ে ক্রুশ-চিহ্নিত বাড়িঘর। সুদূর অতীতে মিশনারিরা প্রবেশ করেছিল এইসব অঞ্চলে। তাঁরই স্মৃতি ছড়িয়ে। পুরোনো প্রাচীন। ধারাগিরি জলপ্রপাতের দিকে যাওতার সময়ই চোখে পড়বে এইসব।

আর রয়েছে প্রাচীন সুবর্ণরেখা। দিনশেষের রাঙা আলোয় গৈরিক তার জল ও দুই পার। তীরে ব্রিটিশ আমলের তামার খনি। নদীতে নাইতে নামে গরুবাছুর। হাঁটুর কাছাকাছি জলে স্নান সারে লোকজন। মাছ ধরা হয়। স্রোত তার কমে এসেছে। চাষের জমিতেও টান পড়েছে জলের। তবু সুবর্ণরেখার জলে সূর্যাস্ত এখনো বড়ো সুন্দর। তবে জানা নেই আজও সেখানে কোনো খেপা সোনা খুঁজে ফেরে কিনা। স্থানীয়রা অবশ্য আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন “ওইইই হোত্থা, বালির নিচে ঘাপটি মারে সোনা… ওইখানকার লোকগুলোই চেনে সেই গোপনস্থান।” আমাদের কিছুটা বিশ্বাস হয়। কিছুটা হয় না। ভেবে নিই, তামাকেই সোনা ভেবে এমন লোককথা।

ঘাটশিলায় গেলে প্রচুর বাঙালি বাড়ির ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ে। কনকলতা ভবন। করুণা ভবন। বাড়ি ঘিরে গাছ ও আগাছারা ভিড় জমিয়েছে। কোনো এককালে বাসা বেঁধেছিল বাঙালি। যেমন পরিযায়ী হয়ে গিয়েছিল, বাসা ছেড়ে এসেছে তেমনি। সেসব জমজিরেত নাকি এখন হস্তান্তরিত । যারা ঘাটশিলার সেসব জমির মালিক তারা কেউ বাঙালি নয়।

এসব বিষয় খানিক পরিষ্কার হল, বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরীকুঞ্জ দেখতে এসে। বাড়ির দেখাশোনা করেন যিনি, জানালেন, ঘাটশিলায় এত বাঙালি ছিল, বাংলা স্কুল ছিল- সব গত পাঁচবছরে হিন্দি করে দেওয়া হয়েছে। কোত্থাও বাংলা নেই আর। অনেক কষ্ট করে, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় টিকিয়ে রাখা হয়েছে বিভূতিভূষণের বাড়ি, ‘আরণ্যক’ লেখার স্মৃতি। সেটাও নাকি ভেঙে দিতে চায় সরকার।

ঘাটশিলা পালামৌ অঞ্চল বাঙালির উপনিবেশই ছিল। তবে তা অর্থনৈতিক নয়, ছিল সাংস্কৃতিক। সেই ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে গভীরভাবে। স্টেশনের ‘ঘাটশিলা’ লেখা ফলকে খোদাই-করা বাংলা হরফ গাঢ় রঙে ঢেকে হিন্দিতে লিখিত হয়েছে স্টেশনের নাম।

যদি এমনটা হত, যে বাঙালির ‘আধিপত্য’ সরিয়ে ঘাটশিলার মূল অধিবাসীরাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে সেখানে, তাহলে এক ব্যাপার ছিল। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়৷ সেখানকার জনজাতির ভাষা কোথায়? কোথায়ই বা অক্ষুণ্ন রাখা হচ্ছে তাদের জঙ্গল? তাদের ওপরেও তো চাপানো হচ্ছে হিন্দির দাবরাব! তাহলে?

ঘাটশিলা এভাবে অনেকগুলি প্রশ্ন মাথায় এনে দিল একে একে। এই অঞ্চলটি এখন না-গ্রাম, না-মফস্বল, না-শহর হয়ে পড়ে আছে। তার নিজস্ব যদি কোনো বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে- আজ তা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। বইতে পড়া জঙ্গল আছে, অবশ্য তা তেমন ঘন নেই আর। সুবর্ণরেখা নদী আছে, তাও অত স্রোতশূন্য। পায়ে পায়ে চলা পথ, ফুলডুংরিপাহাড় - আছে-… তবু কী যেন নেই। আমাদের স্বপ্নে মিশে-থাকা ঘাটশিলাটা কি?