ওয়াং লু-কে মনে পড়ে? মৃণাল সেন পরিচালিত নীল আকাশের নীচে সিনেমার সরল চিনা ফিরিওয়ালা! যে কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বেড়াত। সেই ১৭৮০ থেকেই চিনের ক্যান্টন প্রদেশ থেকে দলে দলে চিনারা এসে কলকাতায় গড়ে তুলেছিল চিনা কলোনি। টেরিটি বাজার বা টেরিট্টি বাজার। মধ্য কলকাতার ভেতর ছোট্ট এক চিন। ট্যাংরা থেকে তোপসিয়া, কলকাতার নতুন চায়না টাউনের বহু আগেই ভারতের একমাত্র পুরোনো চায়না টাউন হল পোদ্দার কোর্টের কাছের এই টেরিটি বাজার। যদিও নতুন চায়না তাউনের চাকচিক্যে জৌলুস হারিয়েছে টেরিটি বাজার। তবু কিছু পুরোনো চিনারা রয়ে গেছেন এখনও। তাঁদেরই একজন জন মার্ক। টেরিটি বাজারের জেড হিঙ্গ চার্চ অ্যান্ড ক্লাবে বসেই শুরু হল আড্ডা।
পারিবারিক সূত্রে ক্যান্টনের বাসিন্দা জনের জন্ম ১৯৫২-য়, এই কলকাতাতেই। ঠাকুরদার বাবা হুয়ান লিং ক্যান্টন থেকে কলকাতায় এসে শুরু করেন কাঠের ফার্নিচার বানানোর ব্যবসা।
কেন এসেছিলেন চিন থেকে?
আমাদের পূর্বপুরুষরা কেন এসেছিলেন সেটা বলা মুশকিল। তবে ঠাকুরদার মুখে গল্প শুনেছি তাঁর বাবা ছিলেন কাঠের কাজের একজন দক্ষ শিল্পী। কলকাতায় তাঁর হাতের কাজের নামডাক ছিল প্রবল। তখনকার দিনের বড়লোক বাড়ির ফার্নিচার বানাতে ডাক পড়ত তাঁর। এমনকি একটা সময় আপনাদের রাইটার রবীন্দ্রনাথের বাড়িতেও ডাক পড়ত তাঁর।
চিনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
সেভাবে যোগাযোগ নেই। তবে কিছু আত্মীয় এখনো রয়ে গেছে ওখানে। যাওয়া হয় না। ঐ আমাদের চিনা নিউইয়ার আর মুনলাইট ফ্যাস্টিভেলের সময় একটা কি দুটো ফোন কল। যোগাযোগ বলতে এইটুকুই।
পূর্বপুরুষের ভিটে দেখতে ইচ্ছে করে না?
আমি হংকং পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। সত্যি বলতে কি, কোনো টান নেই। নামের সঙ্গে চাইনিজ শব্দটা জুড়ে গেলেও আমরা তো আসলে বাঙালিই। এখানেই জন্ম, এখানেই কর্ম। বন্ধুবান্ধবও বাঙালিই।
আপনার কথা কিছু বলুন...
পড়াশুনা বেশিদূর করিনি। বাবার কাছেই ছোটবেলা থেকে কাঠের কাজ শিখেছি। কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আর তেমন বাজার নেই। আমার স্ত্রী একজন গৃহবধূ। দুই ছেলে পড়াশোনা শিখে চাকরি নিয়ে চলে গেছে মুম্বাই। দুটি মেয়ে, আছে আমার কাছেই। আমাদের বাড়ি ছিল এই টেরিটি বাজারেই। কিন্তু ৬২’র যুদ্ধে পুলিশ চিনাদের খুব ধরপাকড় করায় আমরা চলে যাই ট্যাংরার দিকে। এখন ওখানেই থাকি।
কলকাতায় এখন চিনাদের হাল কেমন?
একটা সময় কলকাতা জুড়ে প্রচুর চিনা ছিল। ঠাকুরদার মুখে শুনেছি সংখ্যাটা ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। আমাদের সময় সেটাই নেমে এসেছিল দু-হাজারে। এখন দু-শোও হবে কিনা সন্দেহ। সকলেই চলে যাচ্ছে বিদেশে চাকরি নিয়ে।
আপনার চোখে কলকাতা কেমন?
ভারতের সেরা শহর। দেখুন আমি সারা ভারত ঘুরেছি। কলকাতার মতো শহর কোথাও পাইনি। এই শহরের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। প্রাণ আছে। আমি গোয়া, হায়দরাবাদ মুম্বাইতেও থেকেছি। কোথাও এইরকম মনে হয়নি। দু-দিন কলকাতা ছেড়ে বাইরে থাকলেই মন কেমন করে। তবে একটাই সমস্যা। এখানকার লোকেরা পুজোর চাঁদা নিয়ে বড্ড ঝামেলা করে।
এই শহরে আপনাদের রীতিনীতি কি ভাবে বজায় রেখেছেন এখনও?
রীতিনীতি বলতে নিউইয়ার আর মুন ফেস্টিভ্যাল। দেখুন জন্মসূত্রে আমি চিনা হলেও নিজেকে পুরোপুরি বাঙালিই মনে করি। আগে কলকাতায় চিনা স্কুল ছিল, এখন আর নেই। আমি নিজেই শুধু চিনা ভাষা বলতে পারি, কিন্তু লিখতে পড়তে পারি না। আমাদের ছেলেমেয়েদেরও সেই একই অবস্থা। এখন ইংরেজির রমরমা। চাইনিজ শিখে কী হবে!
মুন ফেস্টিভ্যাল আর নিউ ইয়ার কীভাবে পালন করেন?
আপনাদের যেমন পূর্ণিমা, আমাদের মুন ফেস্টিভ্যালও তাই। এই দিনে আমরা পরিবারের সকলে একসঙ্গে জড়ো হয়ে মুনকেক বানাই। তারপর কেক, ফল শেল বয়েলড গ্রাউন্ডনাট টেবিলে সাজিয়ে চাঁদের আরাধনা করি। আর জানুয়ারির শেষের দিকে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই পড়ে আমাদের নিউ ইয়ার। তখন আমরা সবাই মিলে এখানে ফানুস ওড়াই, মন্দিরে ড্রাগন নাচ হয়। এইটুকুই।
আপনি কি খ্রিষ্টান?
হ্যাঁ। আসলে আমরা ছিলাম বুদ্ধিস্ট। কিন্তু কলকাতায় বুদ্ধিস্টদের কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। আমার স্ত্রী ছিলেন খ্রিষ্টান। তাই বিয়ের সময় আমি ধর্মপরিবর্তন করে ক্যাথলিক হয়ে যাই, ভবিষ্যতের কথা ভেবে। নইলে ছেলেমেয়েরা সমস্যায় পড়ত।
কলকাতায় আপনার কোনো স্মরণীয় ঘটনা মনে পড়ে?
বাবার সঙ্গে একবার সেইসময়কার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম ফার্নিচার বানাতে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। যেমন গম্ভীর, তেমনি মজার। বাবার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ওইরকম মুখ্যমন্ত্রী আমি আর দেখিনি। জানি না, বেঁচে থাকতে আর দেখব কিনা।