শুধু কমিকস্‌ই নয়, পুরোদস্তুর গল্পও লিখেছেন নারায়ণ দেবনাথ!

নারায়ণ দেবনাথ চলে গেলেন। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। তবু কিছু রহিয়া যায়। নারায়ণ দেবনাথ মানেই যে বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা কিংবা নন্টে ফন্টে নয়, তাঁর তুলি আর কালি-কলমের ব্যাপ্তি যে আরও বহু বহুদূর ছড়িয়ে, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, আরও হবে। তাঁর অতুলনীয় সিনেম্যাটিক ইলাস্ট্রেশান, কালো ক্রোক্যুইল নিবের ব্যবহার এখন মিথ। কিন্তু এর ফাঁকেই হারিয়ে যান একজন। লেখক নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath)।

শুনে একটু চমক জাগে, কিন্তু সে চমক নিতান্ত ক্ষণিক। একটু ভেবে দেখলেই দেখি, পৃথিবীর দীর্ঘতম ওয়ান ম্যান কমিকস ইন্ডাস্ট্রি ছিলেন যে মানুষটি, তাঁর প্রতি কমিকসের মজার দৃশ্য, সংলাপ, শট বিভাজন, সবটাই তাঁর নিজের হাতের সৃষ্টি। একজন দক্ষ লেখক ছাড়া এই কাজ অসম্ভব। কিন্তু নিজেকে কোনদিন লেখক বলেননি তিনি। দারুণ সব পাঞ্চলাইন লিখেও সংলাপ রচয়িতার খেতাব চাননি। আগাগোড়া নিজেকে বলতেন ছবি আঁকিয়ে। ইলাস্ট্রেটার। জীবনের একেবারে শেষ পাদে এসে তাঁরও কি সাধ হয়েছিল গল্প লেখার? যে ছবি তাঁর বাহন, তাঁকে একটু পাশে সরিয়ে রেখে কলমকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। লং হ্যান্ডে লিখেছিলেন তিনটি গল্প আর একটা স্মৃতিকথা। শেষটা অসম্পূর্ণ। তবু এই লেখাগুলো আমাদের কাছে অন্য এক নারায়ণ দেবনাথের সন্ধান দেয়। 

২০০২ সালের শৈব ভারতী পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হয় নারায়ণ দেবনাথের ছোটোগল্প, ‘গোবিন্দর গোয়েন্দাগিরি’। লেখার সঙ্গে ছবিও তাঁরই আঁকা। গল্পের শুরুই বেশ মজার “নাম গোবিন্দ। গোবিন্দ পাল। বন্ধুরা ডাকে গবু, গবা, যার যেমন খুশি। গোবিন্দর একটা প্রধান গুণ আছে যার জন্য বন্ধুরা ওঁকে খুবই পছন্দ করে। সেটা হল ওঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জোরে সব সমস্যার সমাধান করতে পারে।” হাজির-বুদ্ধিতে সেরা গোবিন্দ ওই ছোটোগল্পেই অনেক কিছু করে ফেলে। পল্টুর ঘাস ছাঁটার মেশিনকে অটোমেটিক বানিয়ে দেয়, এক বাচ্চা ছেলের পেনসিল কাটা ছুরি চুম্বক দিয়ে উঠিয়ে দেয়, আর সবচেয়ে বড় কথা এক রত্নব্যবসায়ীর হারিয়ে যাওয়া ব্রোচের চোর খুঁজে দেয়। গল্পটির সঙ্গে টিনটিনের ‘পান্না কোথায়’ গল্পের অদ্ভুত মিল মনে রেখেও বলতে হয় নারায়ণী লেখার গুণে গল্পটি একেবারে বাংলার রস গন্ধ পেয়েছে। 

আরও পড়ুন
'পদ্মশ্রী' পাচ্ছেন নারায়ণ দেবনাথ

পরের গল্প অনেক পরে, ২০১২ সালে। নাম ‘এক প্রজাপতির মৃত্যু’। এই গল্পটি, আর আরও একটি গল্প ‘কৌতূহলের বিপদ’ অপ্রকাশিত অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পরে তাঁর কমিকস সমগ্রে স্থান পায়। ‘প্রজাপতির মৃত্যু’-তে প্রজাপতি এক ছোট্ট বছর ছয়েকের মেয়ে। বাবা চাষি। একদিন সেই মেয়ে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ শিবমন্দিরের ঠাকুরদাদুর জন্য ফুল তুলতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। বড় করুণ সেই আখ্যান। একেবারেই চেনা নারায়াণী হিউমার নেই তাতে। শেষ লাইনগুলো এই রকম— “তাঁরই আদরের প্রজাপতি নিথর হয়ে পড়ে আছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার একঝাঁক প্রজাপতি ওঁর শরীর ঘিরে উড়ছে, যেন বলতে চাইছে, শুয়ে আছ কেন? ওঠো, আমাদের সঙ্গে উড়বে চলো।”

আরও পড়ুন
নারায়ণ দেবনাথের অনুপস্থিতিতে এঁকেছেন অন্য শিল্পীরাও, নন্টে-ফন্টের জনপ্রিয়তা ছিল এমনই

বরং তাঁর অন্য গল্প ‘কৌতূহলের বিপদ’-এ নারায়ণ দেবনাথের হিউমার বজায় আছে পুরো। এক মাতালের পিছু ধাওয়া করে তিন বন্ধুর বেপাড়ায় গিয়ে বিপদে পড়ার গল্প। সেখানে একদল লোক তাঁদেরই চোর স্যবস্ত করলে শেষে একজনের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সে বলল “আমরা গজাননবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি এই পাড়ায় থাকেন না?” গোটা গল্পে সেই হাঁদা ভোঁদা বা বাঁটুলের মতো উত্তর কলকাতার পাড়া কালচারের ছাপ।

আরও পড়ুন
নিজে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র, টেনিদা’কে টানা সাত বছর ফেল করালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

স্মৃতির দু’চার পাতা নামের লেখা শুরুই হচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর ভাবে। যেন এক গল্পের বইয়ের মাঝখান থেকে শুরু করা পৃষ্ঠা। “কালী ঠাকুর বিসর্জনের দিন। বিকেলবেলায় পাড়াতে বাজি ফাটানোর প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। কে কত বেশি শব্দ করে বোম ফাটাতে পারে? শিবপুর মন্দিরতলার ঘরে ঘরে তাই বাজি তৈরির কাজ চলছে। সকলকে টেক্কা দিতে আমি আর গণেশ একগাদা বারুদ, রাংতা, কাগজ জড়িয়ে দড়ি দিয়ে বানিয়ে ফেললাম ইয়া বড় একটা বোমা।তারপর মা-র দুটো কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে জোড়া দিয়ে তৈরি করলাম আট দশ হাত লম্বা সলতে, যা এই চত্বরে কেন, গোটা শিবপুরে কেউ দেখেনি। সবশেষে বোমাটার নাম দেওয়া হল ‘দোদোমা স্কোয়ার’।”  এই স্মৃতি কথাটি অসম্পূর্ণ। বহুবার বলা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ে লিখতে রাজি হননি এই লাজুক মানুষটি। আজ এই আত্মপ্রকচারের ঢক্কানিনাদের যুগে একেবারেই যা ব্যতিক্রম। তবে আড্ডা দিতে ভালবাসতেন, আর সেই সুবাদেই উঠে আসত নানা অজানা গল্প। শান্তনু তাঁদের কিছু কিছু লিখে রাখত, কিন্তু সে আর কতটা? এখন মনে হচ্ছে তুলি-কালির বাইরের মানুষটাকে বার করে এনে প্রায় জোর করেই যদি একটা বড়ো স্মৃতিকথাই লেখানো যেত, নেহাত মন্দ হত না। এটা লিখছি, আর নারায়ণ দেবনাথের হাসিমুখ চোখে ভাসছে। এখুনি যেন বলে উঠবেন “আরে আমি সামান্য মানুষ। আমার গল্প কি কেউ শুনতে চাইবে?” 

জানি এই প্রবন্ধ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের না তবু নিজেকে সামলাতে পারছি না। এতদিনের যাতায়াত, গল্প, আড্ডা সব ফিরে ফিরে আসছে। প্রতিবার হাসতপাতাল থেকে ফিরে এসে আমাদের ফোনে গল্প হত। কথা ঠিকঠাক শুনতে পেতেন না, আন্দাজে উত্তর দিতেন অনেকসময়, তবু গল্প চলত।

 এবারের গল্পটা আর শোনা হল না…

Powered by Froala Editor