চরম অবহেলায় ধুঁকছে কাশ্মিরের প্রথম প্রকাশনা সংস্থা

শ্রীনগর শহরের মহারাজগঞ্জ বাজারের মধ্যে ছোট্ট একটি বইয়ের দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ‘গুলাম মহম্মদ নূর মহম্মদ তাজারেন কুতুব’। শ্রীনগর শহরে এমন অনেক বইয়ের দোকানই রয়েছে এখন। এর চেয়ে অনেক বড়ো এবং জাঁকজমকপূর্ণ দোকানও রয়েছে। তাই আলাদা করে এই দোকানের দিকে নজর পড়ে না কারোরই। অজ্ঞাত এক সমাধির মতো রাস্তার একপাশে পড়ে থাকে দোকান। তবে যাঁরা আসেন, তাঁরা জানেন এর ইতিহাস। কাশ্মিরি ভাষাই হয়তো হারিয়ে যেত এই দোকানটি না থাকলে। আর কাশ্মিরি ভাষায় সাহিত্যচর্চা যে আধুনিক যুগে জায়গা পেত না, সে-কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। শতাব্দীপ্রাচীন এই দোকানই কাশ্মিরের (Kashmir) প্রথম প্রকাশনা সংস্থা (Publisher)।

কাশ্মিরি ভাষার বয়স প্রায় ১২০০ বছর। আর কাশ্মিরি ভাষায় সাহিত্যচর্চার ইতিহাসও নতুন নয়। প্রায় ৭০০ বছর আগেই শুরু হয়েছিল পদ্য সাহিত্যের যাত্রা। বাদশাহি দরবারে সাহিত্যচর্চার মেজাজ ছিল অন্যরকম। ভারতের সব অঞ্চলেই তখন পুঁথিতে লিখে রাখা হত সমস্ত সাহিত্য। ছাপাখানার আগমন তখনও হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে দৃশ্যটা বদলে যায় পুরোপুরি। রাজদরবারের অস্তিত্ব মুছে যায়। আর সাহিত্যের জায়গা হয় খোলা বাজারে। ছাপাখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বই ছাপা শুরু হয়। পুঁথির জায়গায় বইই হয়ে ওঠে সাহিত্যের আধার।

মহারাজগঞ্জ বাজারের এই দোকানটি তৈরি হয় ১৮৯০ সালে। ততদিনে দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্তেই ছাপাখানার চল শুরু হয়ে গিয়েছে। নানা ভাষায় বই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু কাশ্মিরি ভাষা থেকে যায় অবহেলায়। ঠিক এই সময়েই এগিয়ে আসেন নূর মহম্মদ। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি টান ছিল তাঁর। আকর্ষণ ছিল সাহিত্যের ইতিহাস নিয়েও। ৭ ভাইয়ের মধ্যে সবার চেয়ে বড়ো নূর। তাই খুব কম বয়সেই এসে পড়ে সংসারের দায়িত্ব। কিন্তু তার মধ্যেও তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন, কাশ্মিরি সাহিত্যকে বাঁচাতে হবে। আর বই প্রকাশ করতে না পারলে সাহিত্যকে বাঁচানোর কোনো রাস্তা নেই।

এই ভাবনা থেকেই শুরু হয়ে যায় কাশ্মিরের প্রথম প্রকাশনা সংস্থার যাত্রা। অবশ্য বইয়ের বাজার বলতে তেমন কিছু তখনও ছিল না কাশ্মিরে। নূর মহম্মদের এই উদ্যোগও তাই বাণিজ্যিক স্বার্থে গড়ে ওঠেনি। বরং নিজের কষ্টোপার্জিত টাকা খরচ করে বইয়ের ব্যবসা চালানো নিয়ে হাসাহাসিই করতেন অনেকে। তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে যায় একটি পদবিও। ‘কিতাবি’। কিতাব, অর্থাৎ বইয়ের পাগল ছিলেন তিনি। নিজে যেমন অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন; ছাপার ব্যবস্থা করেছেন – তেমনই কাশ্মিরি সাহিত্যের নানা প্রাচীন সৃষ্টিও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রকাশনা থেকে। নূর মহম্মদের জীবনকালে অন্তত ২৫০টি বই প্রকাশ করেছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাশ্মিরের দুই প্রাচীন কবি শেখ-উল-আলম এবং লালা দ্যেদ-এর সাহিত্যসৃষ্টি। লালা দ্যেদকে কাশ্মিরি ভাষার প্রথম সাহিত্যিক বলেও মনে করা হয়।

আরও পড়ুন
বাজার ছেয়েছে সস্তা ইরানি আপেলে, সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কাশ্মীরের কৃষকরা

কাশ্মিরি ভাষা সংরক্ষণের পাশাপাশি কাশ্মিরের ইতিহাস সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন নূর মহম্মদ কিতাবি। তিনিই কাশ্মিরের প্রথম ইতিহাস লেখক। কাশ্মিরি ভাষার পাশাপাশি উর্দু ভাষাতেও প্রকাশ করেছেন কাশ্মিরের ইতিহাস। দেশভাগের আগে অবশ্য তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা ছিল না। দিল্লি এবং লাহোর শহর থেকে বই ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। তবে দেশভাগের পর লাহোরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দিল্লির সঙ্গেও কাশ্মিরের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তাই নিজেই একটি ছাপাখানা তৈরি করে ফেলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে নূর মহম্মদের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর তিন ছেলে এখনও তাঁর দোকান ধরে রেখেছেন। অবশ্য ব্যবসা তেমন হয় না এখনও। তাছাড়া নানা সময়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্য বাজারই বন্ধ থাকে পুরোপুরি। তবে এসবের মধ্যেও ইতিহাস আঁকড়ে বেঁচে রয়েছে দোকানটি। আর বেঁচে রয়েছে নূর মহম্মদ কিতাবির নাম।

আরও পড়ুন
উইন্টার অলিম্পিকে প্রথমবার স্কিয়িং-এ ভারত, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন কাশ্মীরের আরিফ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শুকিয়ে যাচ্ছে হিমবাহ, ভাঙছে গ্রামের ঐক্যও; জলবায়ু পরিবর্তনের কোপ কাশ্মীরে