ফিল্ম এডিটিং-এ দুবারের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও এডিটর অর্জুন গৌরিসারিয়ার সঙ্গে হালফিলের এক আড্ডায় সিনেমায় ন্যারেটিভ তৈরির কথাটা উঠে আসছিল বারবার। অর্জুনদা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, 'তোরা আগে গল্প বলাটা শেখ, ন্যারেটিভটা আগে গুলে খেতে হবে তো! ওই অ্যান্টি ন্যারেটিভ ফ্যারেটিভ স-অ-অ-ব হবে পরে।'
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায়, ৭৫তম কান চলচিত্র উৎসবের শেষ দিনে 'প্যালে দে ফেস্টিভাল'-কে এ বছরের মতো বিদায় জানিয়ে স্টেশনের দিকে ঊর্দ্ধশ্বাসে হাঁটতে হাঁটতে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল আমার। আজ মূল ধারার 'ইন কম্পিটিশান ফিচার ফিল্ম' বিভাগের পুরস্কার বিজেতাদের নাম ঘোষণার পর প্রেস কনফারেন্স রুমে একে একে জুরি, ও মূল ফিচার প্রতিযোগিতার নটি বিভাগের বিজয়ী টিমের পরিচালক আমাদের মিট করেছেন। আমি তক্কে তক্কে যাঁর অপেক্ষায় ছিলাম, সেই ইজিপশীয় পরিচালক তারিক সালেহ (Tarik Saleh) এলেন তিন নম্বরে। তারিকের 'বয় ফ্রম হেভেন' (Boy From Heaven) আমার বেশ প্রিয় এক সিনেমা। তার অনেকগুলো কারণও রয়েছে, যার মধ্যে কিছু অবজেক্টিভ আর কিছু সাবজেক্টিভ। সাবজেক্টিভ বলতে, 'বয় ফ্রম হেভেন' এবারের কান ফেস্টিভালের প্রথম সিনেমা, যার ওয়ার্ল্ড প্রেমিয়ারে থাকার সুযোগ ঘটে আমার। শুধু তাই নয়, পরিচালক সহ গোটা টিম লুমিয়ের প্রেক্ষাগৃহে আমার ২টো সারি পেছনেই বসে ছিলেন। কাজেই ফিল্ম শুরু হওয়ার আগের উন্মাদনা এবং মূলত সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর প্রায় দশ থেকে বারো মিনিটের বহুশ্রুত স্ট্যান্ডিং ওভেশনের সাক্ষী থেকেছি আমি। করতালির তাড়নায় হাত ব্যথা হয়ে গেলেও থামবার জো ছিল না। সত্যি কথা বলতে, পরিচালক আর ছবির কলাকুশলীদের আনন্দঘন ছলছলে চোখ আর আবেগের তোড়ে আমরা মানে দর্শকরাও ভেসে গেছি ভালোবাসায়। সে এক মনে রাখার মতো মুহূর্ত বটে!
তবে তার থেকেও যেটা জরুরি, সিনেমাটার সেই অবজেক্টিভ দিক নিয়ে কিছুই না বললে এ-নিবন্ধের সঙ্গে ছলনা করা হয়। আমার মতে, 'বয় ফ্রম হেভেন'-এর মতো একটা সিনেমা সকলের দেখা প্রয়োজন, তাই গল্পের ভিতরে বিশেষ না ঢুকে যেটুকু প্রয়োজনীয় সেটুকুই হাজির করি।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: মুখোমুখি লাল গালিচার চিত্রকর
সুইডেনবাসী তারিক এখন এগজাইলে। দেশের সরকার তাঁর কাজের জন্য তাঁকে ব্রাত্য করেছে। কাজেই তাঁর অন্যান্য সিনেমার মতোই এই ফিল্মের বিষয়েও একটা চমক আছে। সমসাময়িক পৃথিবীতে যুদ্ধ, দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ মানুষেরই গৃহযুদ্ধ বিধস্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান দেশগুলোর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। তার কারণ, মিডিয়া যে-ভাবে ইউক্রেনের মতো খ্রিস্টিয় দেশের সমস্যাকে প্রাধান্য দেয়, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। কাজেই খ্রিস্টিয় অনুষঙ্গের বেশ কিছু তথ্য আমাদের কাছে থাকলেও, ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশগুলোয় সাধারণ মানুষের অভ্যন্তরীণ অবস্থান আমাদের কাছে আবছা। আকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী ইরানি পরিচালক আশগার ফারহাদির মতোই তারিক ঠিক এই জায়গাটা ধরেছেন। তাই সিনেমার গল্পটাই এক্কেবারে মৌলিক।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ইউক্রেনের পরিচালক মাক্সিম নাকোনেশনি-র সাক্ষাৎকার
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ভারতের একমাত্র অফিশিয়াল মনোনয়নপ্রাপ্ত পরিচালকের সাক্ষাৎকার
কাইরোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ইসলাম ধর্মের আঁতুড়ঘর। সেখানকার ইমাম ইসলাম ধর্মের মহাগুরু স্থানীয়। আজ-আজহার থেকেই ভবিষ্যতের ধর্মগুরুরা উঠে আসবেন। তবে শুরুর দিন থেকেই সুন্নি ধর্মালম্বীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আল-আজহারে দাঁত ফোটাতে পারেননি শিয়া সম্প্রদায়। এমনই প্রেক্ষিতে এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমামের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া রাষ্ট্র ও দুই ধর্মমতের নিজস্ব অন্তর্ঘাতের ডায়নামিক্সে পিষ্ট হতে হতেই বড়ো হতে হয় তাকে। সিনেমার শব্দ প্রয়োগ, সিনেমাটোগ্রাফি ইত্যাদির মতো টেকনিকাল বিষয়ে কিছু কিছু গলতি থেকে গেলেও, ইন কম্পিটিশান ফিচার সিনেমাগুলোর মধ্যে 'বয় ফ্রম হেভেন' তার ন্যারেটিভ তৈরির কায়দায় আমাদের সবাইকেই অবাক করে। ঠিক এই জায়গাতেই তার এডিটিং ও স্ক্রিনপ্লে-র জাদুমন্ত্রে আমাদের সিট ছেড়ে একমুহূর্ত নড়তে দেননি তারিক। গল্পের পরতে পরতে আমাদের অজানা মুসলমান সমাজের দৈনন্দিন পাওয়ার স্ট্রাগলের নিদর্শন রেখেছে এই সিনেমা। ছায়াছবির বিষয় ও গল্প বলার মাধুর্যে বশীভূত আমি মনে মনে চেয়েওছিলাম, যেন ৯টি পুরস্কারের একটা অন্তত এ ফিল্মের কপালে জোটে।
দর্শকের ভাবনার সঙ্গে সমবর্তী হয়েই, তারিক সালের 'বয় ফ্রম হেভেন' এবারের বেস্ট-স্ক্রিনপ্লে পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়ে গেল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষে ফেস্টিভালের শেষ প্রেস কনফারেন্সে পরিচালককে ১০ মিনিটের কম সময়ের জন্য হলেও পেয়ে যাওয়ায়, মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা প্রশ্নটা করার সুযোগ পেলাম। জানতে চাইলাম, 'বয় ফ্রম হেভেন'-এর মতো চলচ্চিত্রে যেখানে সিনেমার নায়ককে অনেকটা সময় কেবল নিজের সঙ্গেই ইন্ট্রোস্পেকশনে কাটাতে হচ্ছে, সেই সব নিস্তব্ধ দৃশ্যগুলোকে (যেগুলো মূল গল্পে লেখার দরকার পড়ে না) গল্প থেকে স্ক্রিনপ্লেতে পরিচালক অমন নিখুঁতভাবে তুলে আনলেন কী করে? প্রশ্নটা অবশ্যই লেখনীর ভাব ও টেকনিকালিটি উভয় মাথায় রেখেই। প্রশ্নের গুরুত্বকে স্বীকার করে তার খোলাখুলি উত্তরে তারিক জানান, 'আমি আসলে এই স্ক্রিনপ্লে-টাকে একটা বই হিসাবে লেখারই পরিকল্পনা করেছিলাম। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, পরিচালনার কাজটা আমি মোটেই পছন্দ করি না। ফর মি ইট ইজ এ নেসেসারি ইভিল টু গো অন সেট! একটা বই লিখলে আপনি একজনের ভাবনাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারবেন। বাট আই হ্যাভ অ্যামেজিং একটার্স। ওরাই আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমার দুই কাছের বন্ধু ফারেস ফারেস এবং তৌফিক মারহুম দুজনেই নিজেদের কষ্ট, যন্ত্রণা, প্রত্যাশার মতো চিরন্তন আবেগগুলোকে উজাড় করে চরিত্রদুটোকে নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।"
মিশরীয় পরিচালক তারিক সালেহ-এর এমন উত্তরের পর, কান চলচ্চিত্র উৎসবের কাছ থেকে এক আকণ্ঠ সিনেমা অনুরাগীর আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না। প্রেস কনফারেন্স কমিটির বন্ধুদের সমগ্র ফেস্টিভালের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে আসি আমি। হাঁটতে হাঁটতে প্যালে দে ফেস্টিভালকে পিছনে ঘুরে অদৃশ্য হতে দেখে তারিকের সিনেমার শেষ দৃশ্যে সমুদ্রে নৌকো ভাসার লং শটটা মনে পড়ে যায়। হাজার এক্সপেরিমেন্টেশনের প্রতি শ্রদ্ধা উজাড় করেও, সিনেমাটা শেষমেশ কেবল মনুষ্যত্বের গল্পই হয়ে ওঠে, ভালো ন্যারেটিভই হয়ে ওঠে চিরন্তন সিনেমা।
Powered by Froala Editor