২০১৮ সালের নভেম্বর মাস। ধূধূ শূন্যতা মিউনিখের অ্যালিয়ান্স অ্যারেনা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। হাতে গোনা কয়েক জন সাপোর্ট স্টাফ রয়েছেন মাত্র। এর মধ্যেই একা ঘাম ঝরাচ্ছেন এক খেলোয়াড়। কোনো সতীর্থ নেই। তাঁরা সকলেই খেলতে গেছেন দেশের জন্য। রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকে। সেই পথ ছেড়ে চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু থামেনি লড়াই। অন্য এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অক্লান্তভাবে।
তিনি আর কেউ নন, আর্জেন রবেন। দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান। ২০১৮ সালেই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন রবেন। এবার সরে দাঁড়ালেন ক্লাব ফুটবল থেকেও। গতকাল টুইট করে সব ধরনের ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন ৩৭ বছরের ডাচ তারকা।
১৯৮৪ সালে নেদারল্যান্ডসের গ্রনিঞ্জার শহরে জন্ম রবেনের। বাবা হান্স ছিলেন স্থানীয় গ্রনিঞ্জেন ক্লাবের ফুটবল এজেন্ট। আর সেই দৌলতেই একাধিক তারকা ফুটবলারের সঙ্গে ওঠা-বসা ছিল তাঁর। তখন কতই বা বয়েস রবেনের? বছর পাঁচেক। কিন্তু বিপক্ষের ডিফেন্সে চিরকাল ত্রাস তৈরি করে আসা রবেন কোনোদিনই ভাবেননি তিনি ফুটবলার হয়ে উঠবেন একদিন। বরং সেই বয়স থেকেই বাবার মতো ফুটবল এজেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন রবেন। কিছুই না, শুধু কিংবদন্তিদের সাক্ষাৎ পাওয়ার স্বপ্ন। বাবার কাছে হামেশাই সে-কথা বলে বসতেন ছোট্ট আর্জেন।
কিন্তু চাইলেই তো আর বড়ো কোনো ক্লাবের এজেন্ট হওয়া যায় না। তার জন্য যে ন্যূনতম প্রথাগত জ্ঞান দরকার ফুটবলের। ফলত বছর ছয়েকের আর্জেনকে গ্রনিঞ্জেন এফসির সকার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেছিলেন হান্স। ফুটবল জীবনের শুরু হয় সেই থেকে। গ্রনিঞ্জেনের মূল দলের কোচকেও অবাক করে দিয়েছিল কিশোর আর্জনের প্রতিভা। বছর দশেক বয়সে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ফুটবলার হিসাবে আয়ত্ত করেছিলেন কোয়েরভার মেথড। ফুটবলের অন্যতম কঠিন স্কিল বলেই যা বিবেচিত হয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। যে স্কিলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ডাচ তারকা উইল কোয়েরভার-সহ মারাদোনা, পেলের নাম।
আরও পড়ুন
সালকিয়ার মাঠ থেকে বায়ার্ন মিউনিখ, রূপকথার উড়ান বাঙালি ফুটবলারের
এহেন তরুণ তারকাকে হাতছাড়া করেনি গ্রনিঞ্জেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই গ্রনিঞ্জেনের মূল দলে সুযোগ চলে আসে ফু্ল ফোটানোর। একুশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক সেটা। শুরুতে কয়েকটা ম্যাচ পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে খেললেও ধারাবাহিকভাবেই রবেন গোটা সিসনে খেলেছিলেন প্রথম একাদশে। সংগ্রহ ৩টি গোল, ৬টি অ্যাসিস্ট। ক্লাব ফুটবলের শুরুর মরশুমেই আদায় করে নিয়েছিলেন ক্লাবের ‘প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাব।
আরও পড়ুন
মিস করেননি একটিও ম্যাচ, সদ্যপ্রয়াত দম্পতিকে বিরল সম্মাননা তুর্কির ফুটবল ক্লাবের
তাঁর দুরন্ত গতি, ড্রিবিলিং স্কিল, ডিফেন্স চেরা পাস, অতর্কিত আক্রমণ, দূরপাল্লার শট— সেই সময় থেকেই নজর কেড়েছিল বিশ্বের প্রভাবশালী ফুটবল ক্লাবগুলির। ফলত, বছর দুয়েক বাদেই স্থানান্তরিত হলেন পিএসভিতে। তারপর চেলসি। প্রথম বছরেই লিগ এনে দিলেন লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাবকে। শুরু হল এক নতুন ইতিহাস রচনা। চেলসি’তে খেলার সময়ই নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলেন রবেন। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার থেকে হয়ে উঠলে ক্ষুরধার উইঙ্গার। তারপর বয়স যত বেড়েছে তত ধারালো হয়েছে তাঁর শাণিত আক্রমণ। তিন বছরে রবেন মোট ৬টি ট্রফি এনে দিয়েছিলেন চেলসিকে।
আরও পড়ুন
বুটজোড়া তুলে রাখলেন আন্দ্রে শার্লা, অথচ কথা ছিল লেফট উইং-এ ফুল ফোটানোর
এরপর ২০০৭ সালে মাদ্রিদযাত্রা। রিয়ালে গিয়ে পাশে পেলেন ওয়েসলি স্নাইডার, কাকার মতো তারকাদের। কিন্তু স্পেনের মাঠে সেভাবে ঝলসে উঠতে পারলেন না ডাচ তারকা। সুযোগই বা পেয়েছিলেন কতটুকু? না, সমগোত্রীয় খেলোয়াড়দের জন্য নয় বরং তাঁর মূল শত্রু হয়ে উঠেছিল চোটাঘাত। তা সত্ত্বেও দুই মরশুমে সংগ্রহ ১৩টি গোল। রবেনের সোনার কেরিয়ার শুরু হয় রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর। একদিকে যেমন একের পর এক ট্রফিজয় বায়ার্নের হয়ে, তেমনই বিশ্বের প্রথম সারিতে জাতীয় দলকে তুলে আনা। তবে ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি। ২০১০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে দু’বার ক্যাসিয়াস আর একবার ম্যাসচেরানোর কাছে আটকে গেলেন রবেন। সামান্যর জন্য তেকাঠিতে আর বল গলানো হয়নি। অধরা থেকে যায় বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখাও। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে পেনাল্টি শুটআউটে আটকে যাওয়া সেমি-ফাইনালে। ২০১৮ সালে শেষবার বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে উঠতে পারেনি হল্যান্ড। খানিকটা অভিমান নিয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন রবেন।
তবে ক্লাব কেরিয়ারে সাফল্য পেলেও পিছু ছাড়েনি চোটাঘাত। বায়ার্ন মিউনিখের পরিসংখ্যান বলছে জীবনের ২৭.৯ শতাংশ কেরিয়ারই সাইড বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। যেখানে ১০ বছরের কেরিয়ারে তাঁর ৮২৩টি ম্যাচ খেলার কথা শুধু বায়ার্নের হয়ে সেখানে খেলেছেন মাত্র ৬০২টি ম্যাচ। গোলের পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করতে গেলে হয়তো মেসি, রোনাল্ডোদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে যাবেন রবেন। কিন্তু ফুটবলের মাঠে ফুল ফোটানোর কৃতিত্বে চিরকাল তাঁর স্থান থাকবে সামনের সারিতেই।
২০১৯-এর মরশুমে বায়ার্নের হয়ে খেলার পর ক্লাব ছেড়েছিলেন রবেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন বয়স বাড়ছে দ্রুত। বদলে পুরনো ক্লাব গ্রেনিঞ্জেনেই ফিরে গিয়েছিলেন ডাচ তারকা। বছর খানেক সেখানে খেলেই বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন এবার। কিন্তু পারফর্মেন্সের নিরিখে সত্যিই কি পিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি ক্লাবের অন্যান্য খেলোয়াড়দের থেকে? না, তা নয়। কিন্তু ওই যে, ছোট থেকেই তারকা হতে চাননি তিনি। শুধুমাত্র প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন শিল্পকেই। গ্রনিঞ্জেনে কামব্যাকের পর সাফল্য, দর্শকদের সমর্থন পেলেও চোটের জন্য বোধ হয় সেই শিল্পটাকেই মিস করছিলেন ফ্লাইং ডাচম্যান। ফুটবলজগত থেকে সরে যাওয়া হয়তো সেই অভিমান থেকেই…
Powered by Froala Editor