স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ : গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের এক বিস্মৃতপ্রায় কাণ্ডারি

গত কয়েক বছরে একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে ভারত। বিশেষত হিমালয় সংলগ্ন এলাকায় ধ্বস কিংবা হরপা বানের তাণ্ডব বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। কেদারনাথ, হিমাচল প্রদেশে বন্যা, যোশীমঠের ভাঙন কিংবা সাম্প্রতিক উদাহরণ সিকিমের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আদৌ মানুষ কোনো শিক্ষাগ্রহণ করেছে কিনা? প্রশাসন যে শুধু রিপোর্টের লম্বা তালিকায় খবর ‘বাসি’ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, সে আর নতুন করে বলবার নয়। কিন্তু যিনি বলতে থাকেন অনবরত, দিনের দিন অনশন করেন প্রকৃতির জন্য, তিনি প্রশাসনের পক্ষে হয়ে যান মাথাব্যথার কারণ। স্বামী জ্ঞানস্বরূপ আনন্দের (Swami Gyan Swaroop Sanand) ধারাবাহিক ‘গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন’ (Save Ganga Movement) নিয়ে সরকারপক্ষের নীরবতা প্রমাণ করেছিল তার যথার্থতা। গঙ্গার স্বচ্ছতা নিয়ে মুখে বড়ো বড়ো কথা বললেও, আসলে যে সবকিছুই কর্পোরেটের দাস, জ্ঞানস্বরূপজির আন্দোলন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। আর তাই কি ২০১৮ সালে দীর্ঘ অনশনের পর তাঁর মৃত্যু ঘটলেও বহুপ্রশ্নে জর্জরিত থাকে তার কারণ? 

স্বামী জ্ঞানস্বরূপ আনন্দের নামের সঙ্গে হয়তো বহু মানুষেরই পরিচয় নেই। কিংবা ২০১৮-য় তাঁর মৃত্যুসংবাদের খবর ক্ষীণভাবে ছুঁয়ে যেতে পারে স্মৃতিকে। খুবই স্বাভাবিক সেটি। বাংলা থেকে বহুদূরে কর্মক্ষেত্র, আর দ্বিতীয়ত তাঁর নাম প্রকাশ্যে না আসা সম্ভবত বহু গোষ্ঠীর পক্ষেই সুবিধাজনক। তাঁর আসল নাম গুরুদাস আগরওয়াল (Gurudas Agarwal)। জন্ম ১৯৩২ সালে। ছিলেন আইআইটি রুরকির সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট। আইআইটি কানপুরে অধ্যাপনার পাশাপাশি ছিলেন কেন্দ্রের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ পদে। কর্মক্ষেত্রের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় গঙ্গাদূষণ, তার উপরে অনৈতিক নির্মাণকার্যের রূপ এবং সর্বোপরি সরকারের উদাসীনতা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বহুবার। অবশেষে ২০০৮ সালে প্রথমবার অনশনে বসেন তিনি। এরপর ২০০৯, ২০১০, ২০১২-তেও চলে তাঁর ধারাবাহিক অনশন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গঙ্গাজলে রয়েছে একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা আসলে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে জলকে। উচ্চতাপে সেগুলির ক্ষতি হয় না। কিন্তু নদীর উপর অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নষ্ট করতে পারে তাদের গুণ, অন্যদিকে ক্ষতি করবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্র। অবৈধ খনন ও নির্মাণের কাজ ডেকে নিয়ে আসবে ভাঙন। অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এগুলি। গঙ্গার ‘অবিরলতা ও নির্মলতা’ রক্ষার জন্য এটুকুই ছিল তাঁর দাবি।

তখন কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার। তারা সংবেদনশীলতার সঙ্গেই দেখে ব্যাপারটি। বাকি বিষয়গুলি নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলেও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মুলতুবি রাখে সাময়িকভাবে। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশও দেখা করতে আসেন তাঁর সঙ্গে। ২০১১ সালে জি. ডি. আগরওয়াল সন্ন্যাস নেন স্বামী শিবানন্দ মহারাজ স্থাপিত হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমে। তখন তাঁর নাম হয় স্বামী জ্ঞানস্বরূপ আনন্দ। এই আশ্রমের সন্ন্যাসীরা বহু আগে থেকেই লড়ছিলেন গঙ্গাখননের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে। স্বামী গোকুলানন্দ, স্বামী নিগমানন্দরা জীবনের বিনিময়ে লড়াই করেছিলেন এই অবৈধ চক্রগুলির বিরুদ্ধে। 

এর মধ্যে ২০১৪-তে সরকার বদল হয় কেন্দ্রে। ক্ষমতায় আসে বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। বেনারস কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সময় যিনি দাবি করেছিলেন যে, স্বয়ং মা গঙ্গাই তাঁকে ডেকে এনেছেন এখানে। ‘নমামি গঙ্গে’-এর মতো পরিকল্পনাও পরে নিয়ে আসবে তাঁর সরকার। স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানস্বরূপজি সহ গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে এবার পরিস্থিতি অনুকূল হবে। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে আগের তিনটি বাঁধের কাজ পুনরায় শুরু করে দিলেন। সঙ্গে যুক্ত হল আরো তিনটি প্রকল্প। নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের চারধাম যাত্রার নতুন রাস্তা তৈরির প্রস্তুতিও শুরু হয় বেশ সাড়ম্বরে (যা যোশীমঠের ধ্বসের জেরে আপাতত স্থগিত আছে)। ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের চারবছর পূর্তির কয়েক মাস আগে একটি চিঠি দেন জ্ঞানস্বরূপজি। যাতে স্পষ্ট করে উল্লেখিত ছিল কয়েকটি দাবি। যার মধ্যে—এক, ২০১২ সালে গঙ্গা মহাসভায় গৃহিত প্রস্তাব অনুযায়ী আইন পাশ করতে হবে সংসদে। এবং গঙ্গা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে বেসরকারি সংস্থাকে। দুই, গঙ্গা ও তার শাখানদীর উপর সমস্ত বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তিন, নদীখনন, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বৃক্ষচ্ছেদন, খনির কাজের বিরুদ্ধে আইনত পদক্ষেপ নিতে হবে। চার, গঙ্গাভক্তি পর্ষদ গঠন করতে হবে এবং গঙ্গার নির্মাণ প্রকল্পের সমস্ত বিষয়ে তাদের ছাড়পত্র নিতে হবে।

আরও পড়ুন
জলের পাউচ বাড়াচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ পদক্ষেপ ‘প্লাস্টিক ম্যান’-এর

চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা তো দূরের কথা, প্রাপ্তিস্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। অবশেষে ২০১৮-র ২২ জুন আমরণ অনশন শুরু করেন তিনি। উমা ভারতী দেখা করতে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে আর যাই হোক, প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়নি। প্রথম দিকে জলপান করলেও পরে তাও বন্ধ করে দেন। ১১ অক্টোবর, অনশনের ১১১তম দিনে তাঁকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঋষিকেশের এইমসে। পরদিন জানা যায় হৃদরোগে তাঁর মৃত্যুর খবর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৭। বলা হয়, তাঁর শরীরে নাকি পটাশিয়ামের মাত্রা অত্যন্ত কম ছিল, তাই আলাদা করে পটাশিয়াম প্রয়োগ করা হয়। অথচ মৃত্যুর আগের দিনও তিনি চিঠি লিখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তৈরি করে গেছেন প্রেস নোট। পটাশিয়াম কম থাকলে কীভাবে সম্ভব সেটি? এমনকি মৃত্যুর পর সীমিত কয়েকজনকে শুধু দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ফলে সেই নিয়েও আছে ধোঁয়াশা। 

আরও পড়ুন
বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমেই ধাপার দূষণ ঠেকাতে চলেছে কলকাতা

স্বামী জ্ঞানস্বরূপ আনন্দের সব দাবি হয়তো ‘উন্নয়ন’-এর ধারণার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। যুক্তিবাদী অনেকেই আপত্তি জানাবেন গঙ্গাকে ‘মা’ বলে ডাকার প্রসঙ্গে। কিন্তু সেগুলি নেহাৎই গৌণ। যে দাবির জন্য একজন অশীতিপর বৃদ্ধ জীবন বাজি রাখলেন, তা তো শুধু হরিদ্বারের পরিবেশের জন্য নয়। গঙ্গা অববাহিকায় ভারতের প্রায় তিরিশ শতাংশ জনপদ, যার মধ্যে আছে বাংলাও। তিনি লড়েছিলেন সবার জন্য। এক অনভিপ্রেত মৃত্যু হয়তো থামিয়ে দিয়েছে শারীরিক লড়াই। কিন্তু তাঁর আদর্শে মাতৃসদনের সন্ন্যাসীরা এখনও লড়ে যাচ্ছে গঙ্গার জন্য, সকলের জন্য। 

ঋণস্বীকার : 

১। চাই 'অবিরল ও নির্মল গঙ্গা', তাপস দাস, বিজ্ঞান অন্বেষক, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ২০২৩
২। স্বামী জ্ঞানস্বরূপ আনন্দ, নদী আন্দোলনের বীর সন্ন্যাসীরা আর এক আত্মবিস্মৃত রাষ্ট্রের কাহিনি, ডঃ অমিতাভ আইচ এবং তাপস দাস, নভেম্বর ২০১৮,groundxero
৩। Why the death of Ganga Activist Sanand should alarm us, Manini Chatterjee, 22 October, 2018, The Telegraph Online

Powered by Froala Editor

More From Author See More