জলের পাউচ বাড়াচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ পদক্ষেপ ‘প্লাস্টিক ম্যান’-এর

আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ছোট্ট দেশ সেনেগাল। ছোট্ট এই দেশের রাজধানী ডাকারের সমুদ্রতটে গেলেই দেখে মিলবে এক আশ্চর্য দৃশ্যের। সমুদ্রের ঠিক ধারেই জমে রয়েছে বর্জ্যের পাহাড়। আর মাঝে কেউ যেন দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে একটি কাকতাড়ুয়া। তার সারা শরীরে ঝুলছে বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যাগ, কাপ, জলের স্যাশেট। কিন্তু এই আবর্জনার মধ্যে কে রেখে গেল এই কাকতাড়ুয়াকে? কাকে তাড়ানোর জন্যই-বা স্থাপন করা হল সেটি?

না, আক্ষরিক অর্থে কোনো স্ট্যাচু বা মূর্তি নয় এই কাকতাড়ুয়া। একটু কাছে গেলেই বোঝা যাবে, আদতে মূর্তি বলে ভাবা হচ্ছিল যাকে, তিনি আসলে রক্তমাংসের একজন মানুষ। কাক-পক্ষীদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানোও তাঁর উদ্দেশ্য নয়। বরং, প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এহেন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ তাঁর।

মোডউ ফল (Modou Fall)। খাতায় কলমে এটাই তাঁর নাম হলেও, সেনেগালে (Senegal) তিনি পরিচিত ‘প্লাস্টিক ম্যান’ (Plastic Man) নামে। ডাকার শহরেই বেড়ে ওঠা মোডউ-এর। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সেনাগালের একজন সৈনিক হিসাবে। সেই সূত্রেই দেশের সীমান্তে সীমান্তে ঘুরে বেড়াতে হত তাঁকে। এক দশক আগে যখন সেনেগালিজ-মালিয়ান সীমান্তে কর্মরত ছিলেন তিনি, তখন তাঁর নজর কাড়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য। প্রতিবছর হাজার হাজার পরিযায়ী পাখিদের ভিড় জমে এই অঞ্চলে। কৈশোরে একাধিকবার পরিবারের সঙ্গে সেই দৃশ্য দেখতেও এসেছিলেন তিনি। তবে প্রায় দু’দশক পর কর্মসূত্রে সেই একই অঞ্চলে গিয়ে মোডউ লক্ষ করেন বদলে গেছে গোটা সমুদ্রসৈকতের চেহারা। সেখানে শুধুই প্লাস্টিক আর প্লাস্টিক। আর তার ওপরেই কোনোক্রমে আস্তানা করে নেওয়ার প্রচেষ্টা করে চলেছে পরিযায়ী পাখিরা। কখনও কখনও প্লাস্টিকের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে তাদের পা, ডানা। কেউ কেউ আর উড়তে পারছে না, আটকা পড়ে যাচ্ছে এই জঞ্জালের পাহাড়ে। এই দৃশ্যই বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল মোডউকে।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে পথে নামেন তিনি। মোডউ জানেন, এই লড়াই সহজ নয়। আসলে সেনেগাল তথা গোটা আফ্রিকায় প্লাস্টিক বর্জ্যের একটা বড়ো অংশ আসে ‘ওয়ান-টাইম ইউজেবল ওয়াটার স্যাশেট’ থেকে। একটু কঠিন হয়ে গেল কথাটা? কলকাতা বইমেলায় যাঁদের যাওয়ার অভ্যাস রয়েছে, তাঁরা এই বিশেষ পণ্যটির ব্যাপারে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। বইমেলা চত্বরে নীল ড্রামে করে রাখা থাকে ছোটো ছোটো জলের প্যাকেট। যাকে চলতি কথায় আমরা জলের পাউচ’ বলি। কথা হচ্ছে সেই জল নিয়েই। সাধারণত ভারতের বাজারে মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হয় প্লাস্টিকের বোতলে। কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ উৎসবেই দেখা যায় এই স্যাশেটকে। তবে আফ্রিকায় বোতলের পরিবর্তে চল রয়েছে এই প্যাকেটের। তার কারণ জলের এই প্যাকেজিং একদিকে যেমন সাশ্রয়ী, তেমনই এই পদ্ধতিতে দ্রুত জল প্যাকেজিং সম্ভব। তবে এই স্যাশেটের জন্যই ক্রমশ বেড়ে চলেছে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ।

মোডউ জানেন, আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থাই পরোক্ষভাবে দায়ী এই পরিস্থিতির পিছনে। একদিনে তা বদলাবার নয়। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ তিনি। গলায় ‘নন অক্স স্যাশেট প্লাস্টিকেস’ ব্যানার ঝুলিয়ে প্রতিদিনই তিনি পথে নামেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন বর্জ্যের পাহাড়ের মধ্যে। মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগান আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি জলের পাত্র ব্যবহারের জন্য। মোডউ আশাবাদী সমাজের মানসিকতা একদিন বদলাবেই…

Powered by Froala Editor

Latest News See More