অভীক চন্দের প্রয়াণে প্রহর হারাল তার আত্মজনকেও

‘গুড ইভিনিং। ওয়েলকাম টু দ্য শিকাগো ডায়ালগস…’

শনিবার ঘড়ির কাঁটায় ঠিক আটটা বাজলেই প্রহরের পাতায় ভেসে উঠত তাঁর মুখ, চেনা কণ্ঠস্বর। দেশের অন্যতম বেস্টসেলিং লেখক, কবি, ব্যবসায়িক উপদেষ্টা এবং উদ্যোক্তা তিনি। অবশ্য লকডাউনের আবহে এক ভিন্ন রূপে প্রহর পেয়েছিল তাঁকে। প্রহরের একাধিক লাইভ অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন প্রহরের অন্যতম অভিভাবক।

অভীক চন্দ (Avik Chanda)। লেখক-পরিচিতির বাইরেও তাঁর আরও একটি পরিচয় হল, তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা বরুণ চন্দের পুত্র। সম্প্রতি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অভীক। ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়েছিল সংক্রমণ। সোমবার রাতে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫১ বছর। 

অভীকের যাত্রা শুরু কলকাতাতেই। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর অভীক পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লিতে। দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর আবার ফিরে আসা কলকাতায়। তারপর শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেন এক প্রতিষ্ঠিত ইংরাজি দৈনিকে। পরবর্তীতে ব্যবসাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেন অভীক। অন্যদিকে কলম হয়ে ওঠে তাঁর নেশা, আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। 

সেই শুরু। এরপর প্রায় দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন ব্যবসায়িক উপদেষ্টা হিসাবে। সম্প্রতি নিজস্ব স্টার্টআপ সংস্থা ‘নুভা’-ও প্রতিষ্ঠা করেন অভীক। সঙ্গে তালমিলিয়ে চলেছে লেখালিখি, গবেষণাও। তাঁর লেখা ‘ফ্রম কম্যান্ড টু এমপ্যাথি : ইউজিং ইকিউ ইন দ্য এজ অফ ডিসপার্শন’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল পাঠক মহলে। ‘দারা শুকোহ: দ্য ম্যান হু উড বি দ্য কিং’ হয়ে উঠেছিল এ-দেশের অন্যতম নন-ফিকশন বেস্টসেলার। অভীকের এই গ্রন্থে ধরা রয়েছে ইতিহাসের স্বল্পচর্চিত অধ্যায়ের এক বিশদ বিবরণ। তবে শুধু ইতিহাসচর্চাই নয়, এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে অভীকের নিজস্ব চিন্তন, গবেষণা, অনুসন্ধিৎসা। পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল তাঁর বাংলা কবিতার সংকলন ‘যখন বিদেশে’-ও। তাছাড়া চলতি বছরে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে লিখেছিলেন আরও একটি গ্রন্থ ‘ওয়ার্ক থ্রি পয়েন্ট ও’।

ইতিহাস ও সাহিত্যের বাইরেও অভীকের জ্ঞান, পড়াশোনা এবং ব্যক্তিত্ব বার বার অবাক করেছে পাঠকমহলকে। বলতে গেলে যেন আক্ষরিক অর্থেই অভীক ছিলেন এক অলরাউন্ডার। বার বার নতুনের অনুসন্ধানে আনকোরা পথের পথিক হয়েছেন অভীক। চেনা ফর্ম ভেঙে বার করেছেন তুরুপে লুকনো ট্রাম্প কার্ড। কখনও তাঁকে দেখা গেছে ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’-এর ভূমিকায়, কখনও আবার কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিয়েছে অভীক চন্দের ভিতর লুকিয়ে থাকা অ্যাক্টিভিস্ট-সত্তার। তাছাড়া সঞ্চালনা তো রয়েছেই।

বছর তিনেক আগের কথা। প্রহরের পাতায় শুরু হয়েছিল ধারাবাহিক লাইভ অনুষ্ঠান ‘ক্যান্ডিড টক’। সেই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই অভীক চন্দ হয়ে ওঠেন প্রহর.ইন-এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, অভিভাবক, ‘অভীকদা’। এক ঘণ্টার আলোচনামূলক এই অনুষ্ঠানে অভীকের দক্ষ সঞ্চালনা চুম্বকের মতো আটকে রাখত হাজার হাজার দর্শককে। তবে ওই এক ঘণ্টার সময়সীমার বাইরে অভীক চন্দের পূর্বপ্রস্তুতি, আশ্চর্য সময়জ্ঞান, অনুষ্ঠান আয়োজন করার সাবলীল দক্ষতা বার বার মুগ্ধ করেছে আমাদের। প্রতিনিয়ত শিখিয়েছে নতুন কিছু। তাঁর হাত ধরেই প্রহরের পাতায় হাজির হয়েছেন চিন্ময় গুহ, উইলিয়াম ডালরিম্পল, কুণাল বসু, রশিদ খান বা রঘুরাম রাজনের মতো কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বরা। অভীক চন্দের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে ‘শিকাগো ডায়ালগস’ বা ‘ক্যান্টো’-র মতো আন্তর্জাতিক স্মৃতিধার্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত মার্চ মাসে আয়োজিত ভারতের প্রথম ভ্রাম্যমাণ, বহুভাষিক আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব ‘ক্যান্টো’-র পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন অভীক-ই। আর সেই উদ্যোগেরও সহযোগী ছিলাম আমরা, প্রহর.ইন।

সম্প্রতি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আগামী বছরেই গবেষণার কাজে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। সম্প্রতি সে-কথা নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতেও স-উৎসাহে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই বিদায় নিলেন অভীক। শেষবারের মতো সকলকে অবাক করেই হাঁটা দিলেন এক আনকোরা পথে। অভীকের এই অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা দেশের সংস্কৃতি-মহল। শোকস্তব্ধ আমরা, প্রহর.ইন-ও। 

Powered by Froala Editor