একসঙ্গে গান গেয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ, গুরুদেবের উপর ‘রাগ’ হল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লিতে ঝড় উঠলেই ছোট্ট মেয়েটির হৃদয় নেচে উঠত ময়ূরের মতো। গাছেদের তালে তাল মিলিয়ে সুরের বাঁধনে নিজেকে মুক্ত করে দিত সে। উন্মত্ত প্রকৃতি তখন তার গানের শ্রোতা, নাচের মুগ্ধ দর্শক। পাতায় পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দে মিশে যেত আপনমনের কত অজানা মাধুরী। এক সময় মনে হত, গোটা শান্তিনিকেতনটাই যেন তার। সেরকমই এক কালবৈশাখী বিকেলে ‘শ্যামলী’র দাওয়ায় দেখা হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। আগেও অবশ্য দেখেছেন, তাঁকে ঘিরেই তো এখানের সবকিছু। সেই ঘন কালো মেঘের ছায়ায় প্রথম আলাপ শ্বেতশুভ্র ঋষিপ্রতিম মানুষটির সঙ্গে। অন্যদের কাছে তিনি ‘বিরাট’, ‘মহান’, কিন্তু ছোটো মেয়েটির কাছে তিনি একান্ত আপনজন। 

মেয়েটির নাম অণিমা। বাঁকুড়ার সোনামুখীতে মায়ের মামাবাড়িতে ১৯২৪ সালে তাঁর জন্ম। যদিও শৈশব কেটেছে শান্তিনিকেতনেই। পিতা সত্যচরণ ছিলেন বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দায়িত্বে। আর মা অনিলা দেবী ছিলেন আশ্রমের সকল কাজের অন্যতম উদ্যোক্তা। বছর কুড়ি আগে দাদামশাই রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে যোগদান করেন অধ্যাপক রূপে। সেই থেকেই পুরো পরিবার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে। যথাসময়ে স্কুলে পড়াশোনা শুরু হল অণিমার। ততদিনে তাঁর নতুন নাম হয়েছে কণিকা (Kanika Bandyopadhyay)। সেই ঝড়ের বিকেলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন এই নাম। এমনকি নিজে হাতে স্কুলের খাতায় লিখে দিয়েছিলেন, “অণিমার নাম পরিবর্তন করে কণিকা নাম দেওয়া হয়েছে, তার পিতার সম্মতি আছে।”

গান যেমন তাঁর প্রজাপতির ডানা, তেমনই অঙ্ক ছিল সমস্যার আরেক নাম। একবার তো অঙ্কের শিক্ষক ধনপতি লাহা একেবারে শূন্য বসিয়ে দিলেন খাতায়। সেই অপরাধে ক্লাসে দাঁড় করিয়েও রাখা হয় তাঁকে। অভিমান হল প্রচণ্ড। নালিশ জানানোর ‘আপনজন’ তো একজনই আছেন। সব শুনলেন রবীন্দ্রনাথ, শেষে আশ্বাস দিলেন যে ধনপতিবাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন তিনি। ব্যাস, সব অভিমান গলে জল। স্বয়ং গুরুদেব সমাধান করে দিলেন সমস্ত সমস্যা। মনে হতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের ‘বিশালত্ব’ তখনও পুরোপুরি বোঝেননি বলেই হয়তো ছোটো ছোটো আবদার-অভিযোগ নিয়ে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠের মতো হাজির হওয়া যেত তাঁর কাছে। কিন্তু না, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে চিরকালের আপনজন। সঙ্গীতের সাধনায় হোক, কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে।

আর কবি নিজেও গুরুজনের মতো খেয়াল রাখতেন কণিকার শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে। এমনিতেও ছোটোবেলা থেকেই বড্ড অসুখবিসুখের ধাত তাঁর। এদিকে নতুন গান শিখবার জন্য প্রায়ই ডাক পড়ত বড়োদের দলে। সেরকমই একদিন অসুস্থ শরীর নিয়েও পৌঁছোলেন গানের রেওয়াজে। একটা সময়ের পরে কিন্তু আর পারছিলেন না তিনি। রবীন্দ্রনাথকে জানালেনও সে কথা। নিজে হাতে ব্যবস্থা করে দিলেন ওষুধের। জ্বর অবশ্য তাতে কমেনি। এই নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকতেন তিনি। পরে একবার স্বাস্থ্য ফেরানোর জন্য কণিকাকে প্রায় জোর করেই পুরীতে ঘুরতে পাঠালেন তিনি। 

আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা

কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠানও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই। শান্তিনিকেতন আর কলকাতার শিল্পীদের নিয়ে হবে ‘বর্ষামঙ্গল’। সেটা ১৯৩৭ সাল। শান্তিনিকেতনের পত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সদ্যকিশোরী কণিকা তো মুগ্ধ কলকাতার শিল্পীদের পোশাকআশাক দেখে। সারাদিন ঘুরে বেড়ান জোড়াসাঁকোর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। অবশেষে ‘ছায়া’ সিনেমা হলে বর্ষামঙ্গলের দিন কণিকা গান ধরলেন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। ভালোই গাইছিলেন। কিন্তু একটু ‘ভীত’ শোনাচ্ছে কি তাঁর গলা? পাশেই চেয়ারে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। একসময় তিনি নিজেও গলা মেলালেন কণিকার সঙ্গে। খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। যে গুরুর শিক্ষায় উজাড় করে দিচ্ছেন নৈবেদ্যের ঢালি, তিনি যদি নিজেই এসে বসেন উপাসনায়, তাহলে কার না অভিমান হয়? সেদিন বোঝেননি, কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলেন কত বড়ো প্রাপ্তি লুকিয়েছিল সেদিনের সেই ছোট্টো অভিজ্ঞতায়। আরো একটা ‘ভুল’ করেছিলেন কৈশোরের সরলতায়। ‘একদিন চিনে নেবে তারে’ শেখানোর পর গুরুদেব নিজে হাতে লিখে দিলেন গানটি। এরকম তো কত হয়েছে। তাঁকে কাছে পাওয়া সহজ ছিল বলেই হয়তো বুঝতে পারেননি সেই সম্পদের মূল্য। তাই আশ্রমের এক দাদা চাইতেই কিছু না ভেবেই দিয়ে দিলেন সেই কাগজ। 

আরও পড়ুন
মনোমালিন্য চরমে, সুচিত্রা মিত্রের থেকে এক টাকা হলেও বেশি পারিশ্রমিক চাইলেন কণিকা

আসলে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। যতবার আঘাত পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর আশ্বাসবাণীকে। ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ গানটি রেডিওতে গাওয়ার পর কলকাতার এক পত্রিকা বলল, তাঁর গলা নাকি ‘বিশ্রী’। সলিল চৌধুরীর সুরে গান রেকর্ড করেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে বিশ্বভারতীর চাপে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথই শিখিয়েছেন আঘাতের পরশই সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। প্রকৃত আনন্দ তো পথ চাওয়াতেই। সুখে-দুঃখে হাস্যমুখে চলতে হবে পথ। কালবৈশাখীর ঝড় পালটে দেবে সবকিছু, শুধু মনে থেকে যাবে সেই ঝড়ের বিকেলে ঋষিসুলভ মনীষার সান্নিধ্য পাওয়ার অভিজ্ঞতাটুকু। সেই সম্বল নিয়েই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন অন্তরে-বাইরে। জীবন? সে তো এক আনন্দধারা। 

ঋণস্বীকার : আনন্দধারা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor