তিন বাঙালির যুগান্তকারী গবেষণা, উঠে এল বিরল মানসিক রোগের রহস্য

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি। ফরেস্ট গাম্প কিংবা সেভিং প্রাইভেট রায়ানের মতো সিনেমাগুলি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের এই বিষয়ে প্রাথমিক একটা ধারণা রয়েছে। যুদ্ধ বা হিংস্রতার মতো ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার সাক্ষী বা শিকার হলে মানুষ আক্রান্ত হন এই মানসিক রোগে। কিন্তু এই জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য একটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও, তার প্রয়োগে কেন সেরে উঠছেন রোগীরা তা অধরাই ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। এবার সেই রহস্য উন্মোচন করলেন তিন বাঙালি বিজ্ঞানী।  

দেখা গিয়েছিল, পিটিএসডি আক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের শরীরে হঠাতই বেড়ে যায় কর্টিজল হরমোনের পরিমাণ। কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের চিকিৎসাতেও কর্টিজলের প্রয়োগের কারণেও পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পিটিএসডি আক্রান্তের দেহে ওষুধের কাজও করে এই কর্টিজল হরমোনই, যদি তা বাইরে থেকে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এর কারণ কী? মানবদেহে কোথা থেকেই বা ক্ষরিত হয় এই হরমোন? জানা ছিল না চিকিৎসকদের। 

তিন বাঙালি গবেষক সামনে আনলেন সেই তথ্যই। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বেঙ্গালুরুর এনসিবিএসের প্রফেসর সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ দত্ত এবং ফ্রান্সের মন্টেপেলিয়ারের আইএফজির গবেষক প্রবহন চক্রবর্তী। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত স্নায়ুবিদ ব্রুস ম্যাকওয়েনও। যিনি এই বছরেই প্রয়াত হন। এই তিন বিজ্ঞানী জানালেন, মস্তিষ্কের অ্যামিগডলা অংশ থেকেই নিঃসরণ ঘটে এই হরমোনের। এই অ্যামিগডলাই নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের রাগ, দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, কান্নার মতো অনুভূতিদের। কোনো আকস্মিক ভয়ঙ্করতার সাক্ষী হলে সেখান থেকেই হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরণ হয় কর্টিজলের।

ইঁদুরের ওপরে তাঁরা প্রয়োগ করেছিলেন কর্টিজেল। তারপর তাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানান ভয়ঙ্করতার মুখোমুখি হওয়ার ১০ দিন পরেও দেখা দিতে পারে এই ট্রমা। তবে কর্টিজলের প্রয়োগে ইঁদুরদের দেহে পিটিএসডির কোনো লক্ষণ চোখে পড়েনি। পাশাপাশি তাঁরা দেখালেন বীভৎসতার সাক্ষী হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরে প্রয়োগ করলেও কাজ করে এই কর্টিজলের প্রভাব। আগে চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে এর প্রয়োগ না হলে সম্ভব নয় চিকিৎসা। এই গবেষণা জানাচ্ছে, কর্টিজলের পরিমাণ দেহে বেড়ে গেলে মস্তিষ্ক আরও একটি হরমোন নিঃসরণ করে। যা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে কর্টিজলকে। তিন বাঙালি বিজ্ঞানীর এই গবেষণা পত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা বিজ্ঞানপত্র ‘নেচার’-এর একটি জার্নালে।

আরও পড়ুন
একদিনে কলকাতায় আত্মঘাতী ৭, মানসিক অবসাদ না অন্য কিছু?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ভয়ঙ্কর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বহু মানুষ। ইরান, আফগানিস্থান, সিরিয়ার যুদ্ধ, ট্রেড সেন্টার হামলার সময়ও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও ভারতে উড়িষ্যায় সুপার সাইক্লোনের সময়ও আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। অনেক সময় যৌন হেনস্থাতেও মানুষ শিকার হতে পারে পিটিএসডির। তবে চিকিৎসা না হলে দিন দিন এই রোগ গ্রাস করে মানুষকে। বাড়তে থাকে মানসিক চাপ, আতঙ্ক। ভয়ঙ্কর কাল্পনিক দৃশ্যের সাক্ষীও হতে পারেন আক্রান্তরা। পাশাপাশি দেখা দিতে পারে ইনসোমনিয়া, মাথার যন্ত্রণার মতো উপসর্গ। অনেকক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মিশতে পারার ক্ষমতাও হারাতে পারে মানুষ।

আরও পড়ুন
লকডাউন উঠলেও থেকে যাবে মানসিক বদ্ধতা, জানাচ্ছেন অম্বরীশ দাসগুপ্ত

তাঁরা জানান, খুব শীঘ্রই ইঁদুরের পর এই পরীক্ষার ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু হতে চলেছে মানব দেহে। এই নতুন গবেষণা পিটিএসডির মত আশ্চর্য রোগের ওষুধ তৈরিতে যে বিরাট সাহায্য করবে তা বলাই বাহুল্য। রোগের আসল উৎপত্তিস্থল জানতে পারায় খুলে গেল মস্তিষ্কের ভেতরকার রহস্যের দিগন্তও। যার ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে অজানা অনেক তথ্যও হাতে আসতে পারে বিজ্ঞানীদের...

আরও পড়ুন
মানসিক ভারসাম্য হারালেন লকডাউনে, কলকাতায় আত্মহত্যার চেষ্টা ইঞ্জিনিয়ারের

Powered by Froala Editor